ইংরেজি ‘Myth’ শব্দটির উৎপত্তি হয়েছে গ্রীক ভাষার ‘Muthos’ শব্দটি থেকে, বাংলায় এর ভাষান্তর হিসেবে ‘পুরাকথা’ বা ‘অতিকথা’ শব্দগুলি প্রচলিত। পাশ্চাত্যে ‘Mythology’ বলতে যা বোঝায় তার মূল ভিত্তি হল গ্রীক ও ল্যাটিন ঐতিহ্য। ১৮৯০ সালে প্রকাশিত Golden Bough বইটিতে সমাজ-নৃতত্ত্ববিদ স্যার জেমস জর্জ ফ্রেজার তুলনামূলক লোকবিশ্বাসের বিশ্ব-মানচিত্র তৈরী করতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। স্যার জেমস ফ্রেজার, অ্যান্ড্রু ল্যাং ইত্যাদি বিশেষজ্ঞরা যেসব বিশ্ব পুরাকথা সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলিকে মানবসমাজের আদি বিশ্বাসের ইতিকথা বলে অনেকে ব্যাখ্যা করতে চান, কিন্তু এটা মানতেই হবে যে তাঁরা কোনও বিশ্লেষণ পদ্ধতি তুলে ধরতে পারেন নি। পরবর্তীকালের গবেষকদের দৃষ্টিভঙ্গী অবশ্য অনেকটা আলাদা রকমের। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে সিগমুণ্ড ফ্রয়েড প্রমুখ মনোবিজ্ঞানীরা তাঁদের মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে ইউরো-এশীয় পুরাকথার সংগ্রহকে বিশ্লেষণ করতে আরম্ভ করেন। এরপর সমাজ নৃ-বিজ্ঞানীরা ধীরে ধীরে পুরাকাহিনীর মধ্যে সমাজ কাঠামোর রূপ আবিষ্কার করতে থাকেন। ম্যালিনস্কি, রাডক্লিফ-ব্রাউন, এভান্স-প্রিচার্ড ও অক্সফোর্ড স্কুলের গবেষণা এই চিন্তাধারারই অনুবর্তী। ক্রমে সমাজ নৃতত্ত্বের নতুন ব্যাখ্যায় এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয় যে মানবসমাজের বিভিন্ন ব্রত-অনুষ্ঠানের সূত্র পুরাকথার মধ্যে নিহিত।
স্যার জেমস ফ্রেজার যেভাবে পুরাকথার বিশ্লেষণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্ববর্তীকালের দুজন বিখ্যাত গবেষক ব্রনিস্ল ম্যালিনস্কি ও র্যাডক্লিফ-ব্রাউন তার বিরুদ্ধ মত পোষণ করেন। পোল্যাণ্ডজাত বিশেষজ্ঞ ম্যালিনস্কির মতে মিথকে তার সাংস্কৃতিক ক্রিয়াশীলতার নিরিখে বিশ্লেষণ করা যায়। তিনি বলতে চেয়েছিলেন মিথ অলৌকিক গল্প-কাহিনীর আবরণে ঢাকা ইতিহাস নয়, আবার বিজ্ঞানও নয়। আসলে ম্যালিনস্কি পুরাকথাকে অলৌকিক কাহিনীর ভাণ্ডার বলে ভাবেন নি, বরং জনজাতির মনে ও সামাজিক বিন্যাসে মিথের প্রভাব তাঁর চিন্তাধারার কেন্দ্রে ছিল।
সমাজ জীবনে পুরাকথার বাস্তব ভূমিকা আছে এবং মানুষের সামাজিক জীবনধারার সঙ্গে তা নিবিড়ভাবে সংযুক্ত। পুরাকথা স্বীকৃত বাস্তব দলিল বলে ভাবা যেতে পারে, পুরাকথার সামাজিক ভিত্তির মধ্যে তার এই বাস্তব ভিত্তি নিহিত আছে। তাহলে যেসব লোকাচার প্রথা ও সমাজ-বিন্যাসের মধ্যে পুরাকথার প্রত্যক্ষ উল্লেখ পাওয়া যায় সেগুলি আসলে কী? এর উত্তরে বলা যায় এগুলি হল পুরাকথা আশ্রিত ঘটনার বাস্তব ফল। ম্যালিনস্কি পুরাকথার সঙ্গে ধর্মীয় ঘটনা, লোকাচার বা জাদুবিদ্যার সংযোগ দেখেছিলেন। তাঁর বিচারে পুরাকথার আলাদা অস্তিত্ব নেই এবং কোন বৌদ্ধিক বা প্রতীকী অর্থও নেই। মানুষের আবেগময় ইচ্ছার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অলৌকিকের প্রতি ঝোঁক ও লোকাচার বাস্তব অনুভূতির সঙ্গে এক আবেগজনিত প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পুরাকথা কোনও বিষয়ের ব্যাখ্যা দেয়না বা কোন রহস্যের বৌদ্ধিক প্রতিক্রিয়াও তৈরী করে না, তার উদ্দেশ্য সব বিষয়কে বোধের বৃত্তে নিয়ে আসা।
পুরাকথা ও জাদুবিদ্যার মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক আছে। ম্যালিনস্কির মত অনুযায়ী জাদুবিদ্যার আবির্ভাব হয়েছে জাদু সম্পর্কিত লোকাচারের মধ্যে। পুরাকথা ও লোকাচার একে অপরের সঙ্গে যুক্ত, পুরাকথা লোকাচার তৈরী করে এবং জাদুবিদ্যায় বিশ্বাসের সত্যতা প্রতিষ্ঠা করে। ফলাফলের দিক থেকে দেখলে পুরাকথা ও লোকাচারের সম্পর্ককে paradox মনে করা যায়। লেভি-স্ট্রাউস অবশ্য পুরাকথা ও লোকাচারের মধ্যে সম্পর্কের দ্বান্দ্বিক রূপের কথা বলেছেন।
অনেক ক্ষেত্রেই মিথ হল কোনও এক নায়কের কথা, সেই নায়কের লৌকিক বা অলৌকিক উভয়বিধ কীর্তিকলাপ নিয়ে পুরাকথার কাহিনী অংশ রচিত হয়। বিভিন্ন ধর্মীয় আচারের মধ্যে পুরাকথার অনেক প্রসঙ্গই বার বার ঘুরেফিরে আসে। এর কারণ হল এইসব প্রসঙ্গের উল্লেখ সামাজিক সম্পর্ক বা বংশের উৎপত্তি বিষয়ক গাথার তাৎপর্য প্রতিষ্ঠিত করে। আসলে মানুষ ভেবেছে অতীতের কোন যুদ্ধজয়ের ঘটনা, কোন নায়কের বীরত্ব ও সেই ব্যক্তির স্তুতি, দেবতাদের স্তব-স্তুতি ইত্যাদি বারবার আউড়ে সে সিদ্ধিলাভ করবে। এই বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে মানুষ পুরাকথার লৌকিক নায়কের চরিত্রে অলৌকিক মাহাত্ম্য আরোপ করেছে।
যে ব্যক্তির থেকে একটি রাজবংশের সূচনা তাঁর কোন অলৌকিক উপায়ে আর্বিভাব হয়েছিল বা কোন দৈব আদেশ পেয়ে তিনি সামাজিক নিয়মাবলী তৈরী করেছিলেন পুরাকথায় সেসবের বর্ণনা থাকে। একইভাবে পুরাকথা বলে কোন জনগোষ্ঠীর প্রথম পুরোহিত বা গুরু কোন দৈব আদেশের বলে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং বিধি-নিয়ম তৈরী করেছিলেন। পুরাকথায় বর্ণিত কাহিনীগুলি আবার অনেকক্ষেত্রে বলে একটি রাজবংশ বা গোত্রের প্রতীকী রূপ বা ‘Totem’ কীভাবে এল।ম্যলিনস্কির মত অনুযায়ী গাথা বলতে সচরাচর বোঝায় কোন নায়কের বীরত্বব্যঞ্জক কীর্তিকাহিনী যা প্রায় ইতিহাসের পর্যায়েই পড়ে বলা চলে। রূপকথা (Folktale) ও পুরাকথার (Mythology) মধ্যে কিন্তু মূলগত পার্থক্য আছে। রূপকথায় সাধারণত বিনোদনের উদ্দেশ্যে অলৌকিক গল্পকথা বলা হয়। আর পুরাকথা হল মূলত একটি উচ্চ ভাবাদর্শের কাহিনী অংশ যার উপর কোন জনগোষ্ঠীর নৈতিকতার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়।
ম্যালিনস্কি জোর দিয়েছিলেন পুরাকথার সমাজতাত্ত্বিক ভূমিকার ওপর। অন্যদিকে মির্চা এলিয়াড বিশ্বসৃষ্টির রহস্যকে পুরাকথার বিষয়বস্তু বলে মনে করেছেন। তাঁর মতে শিল্পবিপ্লবের পরবর্তীকালে মানবসমাজের একটা প্রবণতা হচ্ছে যা কিছু অলীক তাকেই মিথ বলে ধরা এবং যা অলীক নয় তাকেই বাস্তবের আধারে ঐতিহাসিক তথ্য বলে মনে করা। তিনি মনে করেন আধুনিক মিথ তৈরী হয় রাজনৈতিক কাজকর্মের মাধ্যমে। এটা যদি মেনে নিই তাহলে বলতে হয় আধুনিক মানুষের মনেও মিথের অস্তিত্ব আছে।
এডমাণ্ড্ লীচ বলেছেন পুরাকথা প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের কাহিনীমূলক অংশ এবং তা ill-defined শব্দশ্রেণীর মধ্যে পড়ে। তাহলে পুরাকথা বা মিথ আসলে কী? এডমাণ্ড্ লীচ-এর কথায়, “Some people uses the word as if it meant fallacious history about the past which we know to be false: to say that an event is ‘mythical’ is equivalent to saying that it did not happen. The theological usage is rather different: Myth is equivalent to religious mystery – ‘the expression of unobservable realities in terms of observable phenomena’. This comes close to the anthropologist’s usual view that myth is a sacred tale.” এছাড়াও নানাভাবে মিথের সংজ্ঞা দেওয়া যায়। যেমন এমিল ডুরখাইম অভিমত প্রকাশ করেছেন যে মিথের প্রধান কার্যকারিতা হল সমাজগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে নিয়ন্ত্রিত করা। আবার আর্নেষ্ট ক্যাসিরা মনে করেন সমগ্র জাতিগোষ্ঠীর সমবেত মানসিকতার প্রতিফলন যা নির্বাচন করে একটি নিদিষ্ট শৈলীকে। ডেভিড বিডনী বলেছেন, “Myth is a universal cultural phenomenon originating in a plurality of motives and involving all mental faculties.” বরেণ্য গবেষকদের মতামত পর্যালোচনা করলে মনে হয় তাঁরা যেন মিথ এর সার্বজনীন চরিত্র খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
পঞ্চাশের দশক থেকে বিখ্যাত ফরাসী বিশেষজ্ঞ ক্লদ লেভী-স্ট্রাউস পুরাকথার ব্যাখ্যায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। তিনি বহুশ্রত ইউরো-এশীয় পুরাকথার চেনা বৃত্তান্তের বাইরে গিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিভিন্ন জনজাতির পুরাকথাগুলিকে এক অবয়বী ব্যাখ্যার ছকে নিয়ে আসতে প্রয়াসী হন। তিনি দুদিক থেকে পুরাকথার বিশ্লেষণ করেছেন – একটি গঠনগত ও যুক্তিগত দিক এবং অপরটি রূপকের দিক। পুরাকথা মূলগতভাবে রূপকধর্মী। এখানে মনে রাখতে হবে একটি জগৎ থেকে অন্য একটি জগতের যুক্তিসঙ্গত সম্পর্কের থেকে যে বোধ জন্ম নেয় তার উপর রূপক নির্ভর করে। আমরা পুরাকথায় দেখি মানুষ প্রাণী ও উদ্ভিদের সাথে কথা বলে, তারা সমুদ্রে বা আকাশে বাস করে। ‘The Savage Mind’ (১৯৬২)বইতে লেভী-স্ট্রাউস অভিমত প্রকাশ করেছেন যে পুরাকথা বলা হয়েছে রূপকের (Metaphor) মত করে। রূপক ভাষার একটি মৌলিক ঢং বলে ধরা য়ায়, বক্রোক্তি (trope), অলংকারসমৃদ্ধ ভাষা (figurative language), কাব্য (poetry) প্রভৃতি শব্দগুলিকে রূপকের মধ্যে ধরা যায়। এই যুক্তির উপর দাঁড়িয়ে লেভী-স্ট্রাউস দার্শনিক রুশোর রচনার মধ্যে তাঁর যুক্তির কাঙ্খিত সমর্থন খুঁজে পেয়েছেন। Totemism (১৯৬২) বইতে তিনি লিখেছেন, “Metaphor, the role of which in totemism we have repeatedly underlined is not a later embellishment of language but one of its fundamental modes. Placed by Rousseau on the same plane as opposition, it constitutes, on the same ground, a discursive thought.”
‘The Savage Mind’ (১৯৬২) এবং Totemism (১৯৬২) বইদুটিতে লেভী-স্ট্রাউস আদিম শ্রেণীকরণ ও অন্বয়প্রবণ যুক্তিপদ্ধতির যুক্তিগত ব্যাখ্যা দিতে প্রয়াসী হয়েছেন। ‘The Mythologique’ (১৯৬৪) বইটিতে তিনি দেখিয়েছেন প্রকৃতপক্ষে কিছু গঠনমূলক নীতি পুরাকথার চিন্তাধারা নিয়ন্ত্রণ করে। বিভিন্ন পৌরাণিক বিষয়ের আপাতদৃষ্টিতে রহস্যময় দিকগুলির ব্যাখ্যা দেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি Semiology-র উপর ভরসা করেছেন। তিনি ও ভাষাতত্ত্ববিদ জেকবসন মনে করেন ভাষাগত বিকৃতি না ঘটিয়ে কোন কবিতা অনুবাদ করা যায় না, কিন্তু পুরাকথার ক্ষেত্রে অন্য ভাষায় অনুবাদের ফলে কিছুটা ভাষাগত বিকৃতি ঘটলেও মূল ভাবাদর্শ অবিকৃত থাকে। তাঁর ভাষায়, “Poetry is a kind of speech which cannot be translated except at the cost of serious distortions; whereas the mythical value of the myth is preserved even though the worst translations.” তিনি যে কাব্য সমালোচনার চেনা ছক থেকে পুরাকথা সমালোচনার ছক আলাদা করতে চেয়েছেন সেটা দেখানোর জন্য তাঁর রচনা থেকে একটি উদ্ধৃতি দেওয়া হল, “Myth should be placed in the gamut of linguistic expression at the end opposite to that of poetry.” তিনি ও জেকবসন পুরাকথাকে শাশ্বতের মর্যাদা দিতে চেয়েছেন এবং বলতে চেয়েছেন পুরাকথার পদ্ধতি কবিতার থেকে পৃথক। এর স্বপক্ষে যুক্তি হল পরিবর্তিত অবস্থাতেও পুরাকথা তার মূল কার্যকারিতা থেকে সরে আসে না। তাঁরা বোদলেয়ারের একটি সনেট বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন কবিতাকেও পুরাকথার মত অবয়বী বিশ্লেষণে আনা যায়। অবশ্য কবি টি. এস, এলিয়ট এর সমালোচনা করে মন্তব্য করেছিলেন কবিতার এরকম বিশ্লেষণ হল, “The lemon-squeezer school of criticism.” এই প্রসঙ্গে বলি মেরী ডগলাসের অভিমত হল পুরাকথার অবয়বী ব্যাখ্যা সমাজমানসকে যতটা ব্যাখ্যা করতে পেরেছে উপসংহারে পুরাকথার ভাবের গরিমা ঠিক ততখানি প্রকাশ পায় না। কিন্তু পাশাপাশি এটাও তিনি বলেছেন পুরাকথার পটভূমিকা বুঝতে না পারলে দেশজ শ্রোতারা কোন্ ভাবগত বা কার্যগত অর্থে ঐ পুরাকথাটি গ্রহণ করছে তা ধরতে পারা যায় না। আবার এডমাণ্ড লীচ ইহুদি পুরাকথা আলোচনায় নেতিবাচক ও অস্তিত্ববাতক প্রতীকী প্রয়োগকে জীবন ও মৃত্যুর আলোকে ব্যাখ্যা করেছেন।
লেভী-স্ট্রাউসের অভিমত, “When a mythical scheme is transmitted from one population to another, and there exists differences of language, social organization or way of life which makes the myth difficult to communicate, it begins to become impoverished or confused.” তিনি মনে করেন শব্দ এককভাবে বা শব্দগুচ্ছ সমষ্টিগতভাবে যে অভিঘাত প্রকাশ করে তা বিচার করা উচিত। এইভাবেই তিনি পুরাকথার গঠনশৈলী ও বক্তব্যের সঙ্গে যে ভাষা ও শৈলীর মাধ্যমে বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছে তাও বিশ্লেষণের পক্ষপাতী। এক্ষেত্রে তিনি ভাষাতত্ত্ববিদদের বিশ্লেষণ পদ্ধতি অনুসরণ করতে চেয়েছেন। ‘Levi-Strauss and Myth’ নিবন্ধে বিশিষ্ট সমালোচক K. O. L. Burridge-এর মন্তব্য উদ্ধৃত করছি, “Myths are reservoirs of articulate thought on the level of the collective. But they are not simply ‘articulate thought’ in a vacuum. They represent the thought of people about themselves and their condition. Moreover, the words of a myth, especially when set down in writing appear to have an ‘objective’ existence irrespective of the attitudes and approaches of narrator, listeners, or observer.”
‘Totemism’ গ্রন্থে লেভী-স্ট্রাউস ব্যবহার করলেন জেকবসনের ভাষাতত্ত্ব আশ্রয়ী মত এবং বাকরহিততার তত্ত্বে ব্যবহৃত দ্বিবিভাজন (combination এবং selection) পদ্ধতি। ওজিবুয়া পুরাকথায় দেখা যায় মানুষ ও টোটেমের পাশাপাশি অবস্থানে সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক হতে হবে মুখোশ পরে। ভারতের পুরাকথায় শনিদেবের কাহিনী বলে যে তিনি মানুষের মুখের দিকে তাকালে মানুষ মারা যায়। অতএব দেবতা মুখোশ পরছেন, সেইজন্য রূপকাশ্রয়ী। এখানে বলে রাখি লেভী-স্ট্রাউস অলংকার শাস্ত্রের ‘লক্ষণা’ (Metonymy) শব্দটিকে ‘রূপকে’র (Metaphor) বিপরীতধর্মী শব্দ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। পুরাকথা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে টোটেমবাদ লক্ষণাশ্রয়ী নয়, আসলে তা রূপককে আশ্রয় করেছে। সুতরাং আমরা সিদ্দান্তে আসতে পারি টোটেমীয় রীতি হল রূপকাশ্রয়ী রীতি, কিন্তু ধর্মীয় আচার-অনু্ষ্ঠান চরিত্রগতভাবে লক্ষণাত্মক।
লেভী-স্ট্রাউস বলেন পুরাকথা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হয়ে মৌখিক ঐতিহ্যরূপে চলে আসে। পুরাকাহিনীর বহিরঙ্গ বিশ্লেষণে প্রায়ই আপাততুচ্ছ ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং একই বিষয়ের উপর বারবার আলোচনা চোখে পড়ে। কিন্তু অন্তরঙ্গ বিশ্লেষণে দেখা যাবে পুরাকাহিনীগুলির বাহ্যিক অর্থের অন্তরালে যে মূল বক্তব্য আছে তা সংকেতের মাধ্যমে বোঝা যায়। সুতরাং পুরাকথার বাহ্যিক গঠন যুক্তিসহকারে ব্যাখ্যা করলে তার ভিতরে প্রচ্ছন্ন অর্থ প্রকাশ পাবে। আসলে পুরাকথা মানুষের অবচেতন মনের ইচ্ছাকে প্রকাশ করে, যার সাথে চেতন মনের অভিজ্ঞতার পুরোপুরি সামঞ্জস্য থাকে না।
আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত আছে তার স্থায়িত্ব র্নিভর করে ছোট ছোট গোষ্ঠীগুলির মধ্যে মিত্রতার সম্পর্ক কতদিন স্থায়ী হবে তার উপর। সেই আমলে নারী উপহারের মাধ্যমে এই মিত্রতার সম্পর্ক তৈরী হত, যাকে লেভী-স্ট্রাউস নারী বিনিময় বলেছেন। পুরাকথায় প্রায়ই দেখা যায় অন্য কোন গুরুত্বপূর্ণ গোষ্ঠীর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক স্থাপনের জন্য (বা অনেক সময় সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও) গোষ্ঠীপতি তাঁর মেয়ের বা বোনের বিয়ে দিচ্ছেন। সুতরাং বিবাহ এখানে সমাজে মিত্রতার সম্পর্ক তৈরীর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কৌশল অবলম্বন করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সমাজের শক্তি ও অর্জিত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ। লেভী-স্ট্রাউসের নারী-বিনিময়ের তত্ত্ব এই কাঠামোর উপর দাঁড়িয়ে আছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে এডমাণ্ড লীচ বলেছেন সামাজিক গোষ্ঠীর দুটি বিভাগ – নারীদাতা এবং নারীগ্রহীতা। যদি পুরুষকে সামাজিক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নারীকে অন্যের কাছে ছেড়ে দিতে হয় তাহলে সেই নারীদের সঙ্গে যৌনমিলন থেকে বিরত থাকতে হবে। এই কারণে আদিম সমাজে গোষ্ঠীর বাইরে বিবাহ করা এবং অবৈধ যৌন সংসর্গে লিপ্ত হওয়ার ঘটনাকে প্রায় একইরকম নজরে দেখা হয়। একইসঙ্গে অগম্যা বলে পরিচিতা নারীতে গমন করায় নিষেধ আদিম সামাজিক ব্যবস্থার একেবারে গভীরে রয়েছে।
বিভিন্ন মিথকে বিশ্লেষণ করে লেভী-স্ট্রাউস যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তাকে যদি আমরা গ্রহণ করি তাহলে বলতে হয় কদমুস-ইউরোপা, ইদিপাস-যোকাস্তা এবং আন্তিগোনে-পলিনিসেস এই তিনটি ঘটনায় যে ধরণের দোষ আছে তা হল অগম্যাগমন। এর পাশাপাশি ইদিপাস-লাইয়ুস এবং এডিওক্লোস-পলিনিসেস এই ঘটনাদুটিতে পিতৃহত্যা বা ভ্রাতৃহত্যা ধরনের দোষ বর্তমান। পুরাকথায় বর্ণিত কাহিনী অগম্যা নারীতে গমন, পিতা বা ভ্রাতাকে হত্যা ইত্যাদি বিষয়ের মধ্যে বিরোধ বা আপাতবিরোধকে রূপকের সাহায্যে দেখায়।
সংস্কৃতির মধ্যে যে দ্বান্দ্বিকতা অন্তর্নিহিত আছে পুরাকথা তাকে বেশ স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। লোকযুক্তি এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। লোকমানসে শ্রেণীকরণের মাধ্যমে বিরোধের ভাবরূপ ফুটে ওঠে ষা মূর্তকে চিহ্নিত করে থাকে। শব্দ ও নৈঃশব্দ্যের মধ্যে মূলগত পার্থক্য অনুধাবন করলে বিষয়টা বোঝা সহজ হবে। শব্দ দিয়ে (বা আলো দিয়েও) আমরা কোন খবর বোঝাই, যেমন হিন্দু বা বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টধর্মে ভেরী বাজিয়ে বা শাঁখ বাজিয়ে ঘোষণা প্রচলিত আছে। কোন কোন ধর্মে বিশেষ অনুষ্ঠান বা বিষয়ের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য বিশেষ ধরণের শব্দ সংযোগ করার প্রবণতা দেখা যায়, যেমন শেষ বিচারের দিন মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য ভেরী বাজিয়ে ঘোষণার প্রথা আছে।
লেভী-স্ট্রাউসের উপর পাশ্চাত্য দার্শনিক ঐতিহ্যের প্রভাব পড়েছে। তিনি মনে করেন ভাষাতত্ত্বের গবেষণা ক্রমেই বৈপরীত্যের দ্বান্দ্বিকতাকে নির্দেশ করছে, দ্বান্দ্বিকতার এই তত্ত্বটি তিনি হেগেল-মার্কসের ধারা থেকেই নিয়েছেন। হেগেলের বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য হল প্রাতিষ্ঠানিক প্রত্যয়ের সঙ্গে বিরোধী প্রত্যয়ের সংঘাত এক সংশ্লেষের রূপ পায় যা থেকে ভবিষ্যত অগ্রগতির দিকে পদক্ষেপ নেওয়া যায়।
এবার জাঁ পল সার্তের দৃষ্টিভঙ্গীর সঙ্গে লেভী-স্ট্রাউসের দৃষ্টিভঙ্গীর কোথায় বিরোধ সেটা দেখা যাক। সার্ত মনে করেন আদিম মানুষের মনোভাব ছিল প্রাক-যৌক্তিক, যার সঙ্গে আধুনিক মানুষের যৌক্তিক মনোভাবের সাদৃশ্য নেই। ইতিহাস হল কালানুক্রমিক দলিল ষেখানে ঘটনার পারম্পর্য রক্ষিত হয়। কিন্তু পুরাকথা কেবল সাধারণভাবে ঘটনার বর্ণনা দেয়, সেইসব ঘটনার মধ্যে পারম্পর্য থাকে না বা অন্যভাবে বলতে গেলে সেগুলি কালানুক্রমিক নয়। পক্ষান্তরে লেভী-স্ট্রাউসের অভিমত হল ইতিহাস যেখানে যুগের পর যুগ ধরে পৃথককালীন করে কাঠামোগত রূপান্তরের নথিভুক্তিকরণ করে সেখানে পুরাকথা দেশে দেশে এবং কালে কালে সমকালীন করে কাঠামোগত রূপান্তরকে নথিভুক্ত করে। তিনি পুরাকথার গঠন ভঙ্গিমার অন্তর্গত যুক্তিধারার উপর জোর দিয়েছেন। তাঁর মতে পুরাকথা আশ্রয়ী কাহিনীগুলি দ্বান্দ্বিক ছকে ফেলা এবং স্বকীয় যুক্তিধারার অনুসারী। মেরী ডগলাস এই প্রসঙ্গে লিখেছেন, “According to Levi-Strauss, the structure of myth is a dialectical structure in which opposed logical structures are stated, the opposition mediated by a resentment, which again, when its internal structure becomes clear, gives rise to another kind of opposition which on its turn is mediated or resolved and so on.”
ইতিহাস এবং পুরাকথা এই বিষয়দুটি মানুষের ধারণা ও আচরণের সঙ্গে সম্পর্কিত। লেভী-স্ট্রাউস পুরাকথাকে নিছক ইতিহাসের অনুসন্ধান বা সমাজের প্রতিচ্ছবি হিসেবে দেখতে চান নি। তিনি পুরাকথাকে দার্শনিকসুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে দেখেছেন, সৃজনধমী বিকাশের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চেয়েছেন। বিরোধ এবং নিষ্পত্তি উভয়ের প্রতি নজর রেখেই পুরাকথার কাহিনীগুলির অন্তর্নিহিত অর্থ বিচার করতে হবে। তিনি সিদ্ধান্ত করেছেন পুরাকথা মানুষের সমাজ-সংস্কৃতির নিগূঢ় বিরুদ্ধ সত্তার উপাদানগুলিকে নির্দিষ্ট করে, সমাজ সত্ত্বার এই বিরোধ নিষ্পত্তির এষণাই পুরাকথার মাধ্যমে চিত্রিত হয়। এই দিক থেকে দেখলে পুরাকথায় সমাজ-দ্বন্দ্বের নিদর্শন চিত্রিত হয় এবং পুরাকথার অভিপ্রেত লক্ষ্য হল সংশ্লেষ-এষণা। পুরাকথায় প্রকাশ্যে অকথিত সমাজমনের নিগূঢ় দ্বন্দ্বের প্রকাশ যেমন থাকবে, তেমনই উপসংহারে সহজ নিষ্পত্তির আদর্শও থাকবে।
লেভী-স্ট্রাউস ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত “Structural Study of Myth” গ্রন্থে তাঁর পুরাকথা বিশ্লেষণের পদ্ধতি আলোচনা করেছেন। তিনি মনে করেন পুরাকথা একটি বিশেষ মানসিকতা থেকে সৃষ্টি হয় এবং পুরাকথাকে খণ্ডিত ভাবে না দেখে সামগ্রিকভাবে দেখা প্রয়োজন। তিনি নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে স্বতন্ত্র Mythologiques গড়ে তুলতে চেয়েছেন। অধ্যাপিকা মেরী ডগলাস এই সিদ্ধান্ত মানেন নি। তবে তিনি যাই বলুন না কেন বৃটেনের সমাজ-নৃতত্ত্ব চর্চায় পাশ্চাত্য মহাদেশীয় দাশনিক প্রভাব খুব একটা পড়েছে বলে মনে হয় না। বৃটিশ গবেষকরা জন লক প্রবর্তিত Empiricism এবং ক্ষেত্র সমীক্ষা থেকে উপলব্ধ জ্ঞানের উপরেই আস্থা রেখেছেন।
লেভী-স্ট্রাউস বলেছিলেন তাঁর দৃষ্টিতে সমাজবিদ্যা communication-এর অংশ। ১৯৬৩ সালে কেমব্রিজের জীসাস কলেজে এক সপ্তাহ ধরে লেভী-স্ট্রাউসের পুরাকথা বিশ্লেষণের উপর আলোচনাসভায় যে সমাজ নৃতাত্ত্বিকরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের নিবন্ধাবলী ১৯৬৭ সালে এডমাণ্ড্ লীচ সম্পাদিত “The Structural Study of Myth and Totemism” নামক বই়টিতে প্রকাশিত হয়। এডমাণ্ড লীচ পরবর্তীকালে পুরাকথার প্রকৃতি সম্বন্ধে বলেছেন –“Nearly all human societies possess a corpus of tradition about their own past. It starts, as the Bible starts, with a story of creation. This is necessarily ‘mythical’ in all senses of the term. But the creation stories are followed by legends about the exploits of culture heroes (e.g. King David and King Solomon), which might have some foundation in ‘true history’, and these in turn lead on to accounts of events which everyone accepts as ‘fully historical’ because their occurrence has been independently recorded in some other source. The Christian New Testament purports to be history from one point of view and myth from another and he is a rash man who seeks to drew a sharp line between the two. ” ভারতীয় মহাকাব্যদুটির ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য।
প্রাচীন উপজাতির মানুষদের মানসপ্রকৃতির সঙ্গে বাহ্যপ্রকৃতির সেতুবন্ধন ঘটিয়েছে তাদের সংস্কৃতি। কিন্তু আধুনিক মানুষের ক্ষেত্রে আবার দেখা যায় সংস্কৃতিবান হওয়ার কারণেই তার সত্বা প্রকৃতির থেকে দূরে সরে গেছে। মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ক প্রকাশ করতে গেলে কিছু প্রতীকের সাহায্য নেওয়া যেমন প্রয়োজন, তেমনই এর পিছনের যুক্তিও অনুধাবন করা দরকার। অবয়বী দৃষ্টি ভঙ্গী সহকারে টোটেমিজমকে যদি দেখতে হয় তাহলে বিভিন্ন পশুশ্রেণীর রূপান্তরকে মানুষের সামাজিক শ্রেণীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করার তাৎপর্য বুঝতে হবে। প্রথমেই যে প্রশ্নটা ওঠে সেটা হল এক্ষেত্রে রূপকের ব্যবহার হয় কেন? এর উত্তরে বলা যায় পশুদের নানা শ্রেণীকে মানুষের নানা শ্রেণীর সমান করে দেখানোর জন্যই রূপকের ব্যবহার হয়। এর সূত্র ধরে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে পরের প্রশ্ন – মানুষ তার চারপাশের পশুপাখি বা গাছপালাকে জড়িয়ে নানারকম আচার-অনুষ্ঠান করতে চায় কেন? একটু ঘুরিয়ে প্রশ্নটা করা যায় এইভাবে – কেন মানুষ পশু বা গাছের পূজাকে অবলম্বন করল বা কল্পনা করল এদের থেকেই তার উদ্ভব হয়েছে? রাডক্লিফ ব্রাউন এর অভিমত হল টোটেম প্রথা আদিম মানুষের শ্রেণী বিভাজক কৌশল। লেভী-স্ট্রাউস এই মতটিতে এক নতুন অর্থগত মাত্রা যোগ করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন টোটেম একটি রূপকাশ্রয়ী রীতি।মিথ বিষয়ক গবেষণা থেকে উঠে এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা –“The concept of life entails the concept of death.” জীবনের ধারণা এবং মৃত্যুর ধারণা পরস্পরের উপর নির্ভরশীল। মৃত্যুকে আবার চিরন্তন জীবনে প্রবেশ করার পথ রূপে দেখান হয়েছে। আমরা যে পুরাকথায় মৃত্যুর ছবি পাই তার কারণ হল ধর্ম জীবন ও মৃত্যুর ধারণাকে আলাদা করে দেখাতে চায়।
গবেষক মির্চা এলিয়াড মনে করেন প্রাথমিকভাবে মিথ একটি পবিত্র গাথা বা কাহিনীর সূচনা করে।মিথকে একটি পবিত্র আখ্যায়িকার পর্যায়ক্রমিক বর্ণনা বলা চলে, তফাৎ শুধু এই যে চরিত্রগুলি অপ্রাকৃত এবং অতিমানুষ। ষেমন পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য বিষয়ক প্রাচীন গাথায়আলোচনা করা হয় দেবতাদের দ্বারা কেমন করে পৃথিবীর সৃষ্টি হল বা গাছপালা, পশুপাখী, মানুষের উৎপত্তি হল। এর সূত্র ধরে কীভাবে কৃষিকাজ শুরু হল বা কোন জীব সংক্রান্ত পুরাকথাই বা কেমন করে এল সেগুলি ব্যাখ্যা করা যায়।
পুরাবৃত্ত হল একপ্রকার সাংস্কৃতিক ভাবাদর্শ যা পৃথিবীর সব জায়গাতেই দেখতে পাওয়া যায়।অতি প্রাচীন যুগ থেকেই জীব ও মানুষের সম্পর্ক পুরাকথার বিষয় হয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে কোন প্রদেশের আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষরা ষখন কোন জীব শিকার করত তখন থেকেই সেই জীবটির বিষয়ে পুরাকথার জন্ম হয়েছিল। কৃষিকাজের ক্ষেত্রে বলা যায় সুদূর অতীতকাল থেকেই বৃষ্টিহীনতা জনিত কারণে খরার সম্ভাবনা দেখা দিলে সেই পরিস্থিতি নিবারণ করার উদ্দ্যেশ্যে মানুষ বৃষ্টির দেবতার স্তুতি করত বা ভালো ফসল পাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে কৃষির দেবতার স্তুতি করত।সেই সময়ের সমাজে এইসব স্তব-স্তুতি ছিল সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। মির্চা এলিয়াডের মতে আজকের যুগের শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থায় আগেকার স্তোত্রগুলি কিছু কিছু অমোঘ বিশ্বাসের সৃষ্টি করেছে। বস্তুত যেসব পুরাকাহিনী ধর্ম বা আদর্শবিহীন সেগুলির কোন ভিত্তি নেই। একই যুক্তিতে ভাবাদর্শহীন সমাজে পুরাকাহিনীর জন্ম হওয়া সম্ভব নয়।
কৃষির আবির্ভাবের ফলে কীভাবে মানুষের মনে সামাজিক মানসিকতার উন্মেষ ঘটেছিল এলিয়াড তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। সুপ্রাচীনকালে মানুষ প্রথমে ছিল খাদ্য সংগ্রাহক এবং শিকার ছিল তার প্রধান অবলম্বন।সেই সময় পুরুষরা শিকারের সন্ধানে জঙ্গলে ঘুরত এবং নারীরা ফলমূল সংগ্রহ করত ও বীজ সংগ্রহ করত। জঙ্গলে বিপদের প্রচুর সম্ভাবনা থাকায় মানুষ একজন রক্ষাকর্তার অস্তিত্ব কল্পনা করেছিল যে তাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাবে। এইভাবেই পশু-দেবতার অস্তিত্ব কল্পনা করা হয়। কিন্তু কৃষির আবির্ভাবের ফলে (তথা মাটির উর্বরাশক্তি লক্ষ্য করে) মানুষের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এল, যাযাবর জীবন ছেড়ে মানুষ ঘর বেঁধে স্থায়ীভাবে বাস করতে শিখল। এর ফলে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা যেমন বাড়ল, তেমনই ধর্মীয় বিশ্বাসের জন্ম হল। কৃষির আবির্ভাবের ফলে মানুষ প্রতীকীরূপে পৃথিবীকে নারী বলে ভাবতে শুরু করে। ক্রমে এরকম ধারণার জন্ম হল যে ধরিত্রী জগৎরূপিনী মাতা যিনি ঈশ্বরপুরুষের দ্বারা অবশ্যই গর্ভবতী হবেন, ভূমি কর্ষণ এবং মৃত্তিকার উর্বরতাসেই মিলনেরই ফলশ্রুতি। এইভাবে পৃথিবীরূপিনী মাতার কল্পনার মধ্যে দিয়ে নারীর উপর সামাজিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব আরোপিত হল এবং প্রজনন চক্রের পুরাকথার প্রসার হল। আসলে কৃষিকাজের সূচনার উপর ধর্মীয় প্রভাব আছে। এর পাশাপাশি বীজ থেকে নতুন গাছ জন্মায় এই আবিষ্কার থেকে মানুষের মনে ধীরে ধীরে বিশ্বাস জাগে যে সৃষ্টিতত্ত্বের মধ্যে অমোঘ বিধান হিসেবে জন্ম-মৃত্যু-পুর্নজন্ম চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে।নব্য প্রস্তর যুগের পরেযখন পৃথিবীর প্রধান ধর্মগুলি নতুনভাবে বিকশিত হয়সেই সময় এজাতীয় ধারণার জন্ম হয়।
পাশ্চাত্যের মিথ বিষয়ক ধারণায় গ্রীক উদাহরণের ছড়াছড়ি। বাইবেলের পূর্ববর্তী কাহিনিগুলি হিব্রুতে লেখা হয়েছিল। আধুনিক গবেষকদের মতে আদি কাব্যিক হিব্রুতে লেখা ‘The Book of Yehweh’ ও ‘The Book of Yashar’ বইদুটিতে আদি ইহুদিদের মরুভূমির মধ্যে পথপরিক্রমা এবং কেনান রাজ্য আক্রমণের বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। কিছু খণ্ডাংশের মধ্যে এর প্রমাণ মেলে। যশুয়ার নিদেশ অনুযায়ী বইটি সাত খণ্ডে সংকলিত হয়েছিল। এর মধ্যে বর্ণিত হয়েছে কেনান ও তার নগরীর কথা (যশুয়া ১৮,১৯), আদমের সৃষ্টি ও তার কাহিনী (জেনেসিস ৬,১), আদম থেকে নোয়া পর্যন্ত দশটি প্রজন্মের বিবরণ। বাইবেলে অনেক হারিয়ে যাওয়া পুরাকথার খোঁজ পাওয়া যায়।বাইবেলের পরবতীকালের ‘মিদ্রাস’-এর ধারায়ও বেশ কয়েকটি চাপা পড়ে থাকা পুরাকথার পুনরুথ্থান হয়।প্রস্থান যাত্রায় (Exodus) আমরা দেখি সমুদ্রের তীরে মিশররাজ ফেরোর ঘোড়ায় টানা রথ এবং ঘোড়সওয়াররা ইজরায়েলের সন্তানদের প্রস্থান পথে আক্রমণ করেছিল। তখন ঈশ্বর একটি ঘোটকীর রূপ ধারণ করেন, তাঁকে দেখে মিশরের ঘোড়াগুলি কামাসক্ত হয় এবং পরিশেষে সমুদ্রের জলে ডুবে মারা যায়। এর পাশাপাশি গ্রীক পুরাকথা অনুযায়ী দেবী ডিমিটারের মাথা ছিল ঘোড়ার মত, তিনি রাজা পেলপের রথ কৌশল করে জলে ডুবিয়ে দিয়েছিলেন। এর থেকে অনুমান করা যেতে পারে যে গ্রীক পুরাকথায় প্রস্থান যাত্রার আভাস আছে।
বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায়ে পূর্ববর্তী যুগের প্রাচীন দেব-দেবীদের ধারণা মিলবে। গবেষকরা মনে করেন আদমের পত্নী ঈভ এবং প্রাচীন দেবী হেবা অভিন্ন। এই হেবা আবার হিটাইটদের ঝড়ের দেবতার পত্নী রূপে পরিচিতা ছিলেন। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিংহের পিঠে আসীন হেবার মূর্তি পেয়েছেন। হেবা রূপান্তরিত হয়ে গ্রীকদের কাছে চিহ্নিত হন হেবে রূপে। গ্রীক পুরাকথা বলে হেবে দেবীর মর্যাদা পেয়েছেন, তাঁর পরিচয় হেরাক্লিসের পত্নী।
ঈভের পূর্ববর্তী লিলিথ ধর্মগ্রন্থ থেকে একরকম নির্বাসিতাই বলা চলে। মিদ্রাসের বর্ণনা অনুযায়ী তিনি কামাসক্তা এবং ব্যভিচারিণী। তিনি নির্জন ধ্বংসস্তুপের কাছে থাকেন। প্রাচীন সুমেরীয় ধর্মগ্রন্থে তিনি লাইল্যাক এবং উইলো গাছ রূপে চিহ্নিত। বাইবেলের বহুল আলোচিত চরিত্র ঈশ্বরের শত্রু স্যাটান প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবর্তিত ধারণা। বাইবেলের পূর্ববর্তী যুগে সামায়েল বা স্যাটানের উল্লেখ দেখা যায়। প্রথমে পুরাকথায় তাঁকে সেমাল রূপে বর্ণনা করা হয়েছিল। ইরানের পূর্বে অবস্থিত সামল নামক একটা ক্ষুদ্র হিটাইট-আরামিক রাজ্যে তিনি প্রথম দেবতারূপে পূজিত হতেন। রাহব হলেন হিব্রু পুরাকাহিনীর একজন প্রায় বিস্মৃত দেবতা। তিনি ইজরায়েলের অধিপতি দেবতা জেহোবাকে তুচ্ছ বলে মনে করেছিলেন বলে জেহোবা তরোয়াল হাতে রাহবের প্রাণনাশ করেন। এর সঙ্গে তুলনীয় গ্রীক মিথটি হল দেবতা পসীডন তাঁর ভাই সর্বশক্তিমান জীউসকে অবজ্ঞা করার ফলে পতিত হয়েছিলেন। গ্রীক দেব-দেবীদের একটা উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল যে মানুষরা তাঁদের অনুগত বা প্রিয়পাত্র এবং যারা তাদের উপাসনা করত সেইসব মানুষদের হয়ে তাঁরা চক্রান্ত করতেন অথবা তাদের পক্ষ নিয়ে নানাভাবে সাহায্য করতেন। তাই এইসব গ্রীক দেব-দেবীরা বিভিন্ন ভূমিকায় অবতীর্ণ হতেন এবং পরস্পরের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামতেন। আমরা দেখি গ্রীক পুরাকথা দেবদেবীদের মধ্যে শত্রুতা বা বন্ধুতার নানারকম কাহিনীতে ভরা।
ইহুদি ও খ্রীষ্টান আধিপত্যের আগে বিভিন্ন জাতি ও উপজাতিগুলির উপাস্য দেবদেবীর একত্রে সংমিশ্রণ দেখা যায়। এই সংমিশ্রণ প্রকৃতপক্ষে ছোট ছোট উপজাতিগুলির মিত্রতা প্রতিষ্ঠিত করার চিন্তা থেকে উদ্ভুত। আবার বাইবেলে যে জোহবার ক্রোধের কথা বলা হয়েছে তা আসলে বিবদমান শত্রু উপজাতিগুলির দেবতাদের বিরুদ্ধে ইহুদিদের রোষের প্রকাশ। তবে বাইবেলের আদিগ্রন্থ জেনেসিসের ঈশ্বর প্রারম্ভিক পর্বে তৎকালীন প্রচলিত উপজাতির দেবতাদের থেকে তখনও স্বতন্ত্র হয়ে উঠতে পারেন নি।
বাইবেলের পুরাকথায় দেখি বীরগণ রাজাদের বা রাজবংশের প্রতিনিধিত্ব করে, পাশাপাশি তারা পৃথক উপজাতিরও প্রতিনিধিত্ব করে। এখানে একটা উদাহরণ দেব। জেকবের দ্বাদশটি পুত্র একসময় আলাদা আলাদা উপজাতির সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় উপজাতিগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ইজরায়েলী সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা মোটামুটিভাবে আরামীয় পুরোহিতদের দ্বারা পরিচালিত হত। এই দ্বাদশ পুত্রের মধ্যে কেবল যোসেফই ঐতিহাসিক চরিত্ররূপে স্বীকৃত। প্রচলিত কিংবদন্তী আমাদের বলে জেকবের অন্য পুত্ররা সবাই যমজ বোনকে বিবাহ করেন। এটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে মাতার সূত্রে জমি পাওয়ার উত্তরাধিকারকে সূচিত করে। জেকবের একমাত্র কন্যা ডিনা কিন্তু যমজ নন। জেনেসিসে উল্লেখ আছে তিনি শেচেমের হাতে নিগৃহীতা হন এবং পরবতীকালে সাইমিয়নের সঙ্গে তার বিবাহ হয়। এই ঘটনাকে ব্যক্তিগত জীবনের কাহিনী বলে না ভেবে বরং রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করাই ভালো।
জেনেসিসে প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির আরো সংকেত পাওয়া যায়। উদাহরণ হিসবে মাতা পুত্রদের নামকরণ করতে পারেন (আরবদের মধ্যেও প্রচলিত) এই প্রথাটির উল্লেখ পাওয়া যায়। মাতৃস্থানিক বিবাহ বলতে বোঝায় স্বামী বিবাহের পর নিজের পিতার গৃহ ত্যাগ করে স্ত্রীর গৃহে বাস করার প্রথা, জেনেসিসে যার উল্লেখ আছে। বাইবেলের বিচারক পর্বে স্যামসন ও ডেলাইলার বিবাহও এই প্রথার উদাহরণ। মাতৃস্থানিক বিবাহের প্রথা গ্রীক পুরাকথায়ও পাওয়া যায়। অডিসাস প্রথম এই প্রথাকে অমান্য করেন। তিনি পেনেলোপকে বিবাহের পর স্পার্টা থেকে ইথাকায় নিয়ে যান, যদিও বিচ্ছেদের পর পেনেলোপ স্পার্টায় প্রত্যাবর্তন করেন।
ইহুদি রাজতন্ত্রে দেবীরা বিশেষ গুরুত্ব পেতেন। পুরাকথাগুলির সংস্কারে রাজা জোসিয়ার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। তখন মিশর ও অ্যাসিরিয়ার মধ্যবর্তী জুডিয়ার স্বতন্ত্রতা রক্ষার জন্য একটি দৃঢ় ধর্মীয় বন্ধন জরুরী ছিল। যে ধর্মবেত্তারা তখন ক্ষুদ্র ইজরায়েলী গোষ্ঠীকে পরিচালনা করতেন তাঁরা বুঝেছিলেন একেশ্বরবাদের মধ্যেই ইজরায়েলের স্বাধীনতার বীজ প্রচ্ছন্ন আছে। রাজা জোসিয়ার তত্ত্বাবধানে আচার-অনুষ্ঠান পালনের নতুন বিধি-বিধান প্রণয়ন করা হয়। এইসব বিধানকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে ক্যানানাইট লোকাচার, সংস্কার, ধর্মানুষ্ঠান বা উৎসবে আনুষ্ঠানিক পতিতাবৃত্তি, সঙ্গমে মাত্রাছাড়া আসক্তি, সমকামিতা, বিভিন্ন ধরণের পৌত্তলিকতা প্রভৃতির বিরোধিতা করা হয়েছে। কালক্রমে জুডিয়া থেকে ক্যানানাইট দেবীদের প্রভাব অবলুপ্ত হয়ে যায়। জ্যেরুবব্যাবেল যখন জেহোবার মন্দির পুননির্মাণ করেন তখন জেহোবার আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না।
জেনেসিসের পুরাকথাগুলির সঙ্গে গ্রীক, ফিনিসীয়, হিটাইট, ইউগারিট, সুমেরীয় ইত্যাদি পুরাকথার সংযোগ ছিল। খ্রীষ্টজন্মের আগে থেকেই ইহুদি দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী এই পুরাকথাগুলির সংস্কার করা শুরু হয়। একটি মিথে হ্যাম বা ক্যানান দ্বারা নোয়ার নির্বীর্যকরণ করার কাহিনী বর্ণিত হয়েছে। নোয়া নিদ্রা থেকে উত্থিত হয়ে জানতে পারেন কনিষ্ঠ পুত্র দ্বারা তাঁর কী বিপদ হয়েছে।এই অংশ জেনেসিস থেকে মুছে ফেলা হয়েছে, পরিমার্জিত সংস্করণে পাই হ্যাম তার পিতার উলঙ্গ রূপ দেখেছিল বলে তাকে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাদের অধীনে দাস হয়ে থাকতে হয়েছিল। এর সঙ্গে একটি গ্রীক মিথের সাদৃশ্য আছে যেখানে বলা হয়েছে ক্রোনাস নামক এক নির্লজ্জ দেবতার কথা, যাঁর বিরুদ্ধে তাঁর সন্তান পসিডন, হেডিস এবং জিউস চক্রান্ত করেছিলেন। কনিষ্ঠ সন্তান জিউস তাঁকে নির্বীয করেছিলেন। এর পরিণতিতে জিউস স্বর্গের রাজা হয়েছিলেন।
গ্রীক মিথে নারীদের অনেক সময়েই অবনমন ঘটানো হয়েছে। মানুষের পতন ঘটানোর জন্য জেহোবা ঈভকে শাস্তি দিয়েছিলেন। তাছাড়া প্যাণ্ডোরার বাক্সকে নিয়ে রচিত হেসিওডের কল্পকাহিনীকে অবলম্বন করে মানুষের দুর্ভাগ্যের জন্য নারীকে দায়ী করা হয়েছে। এর কারণ হল প্যাণ্ডোরার এই বাক্সটি থেকে টাইটানের বুদ্ধিহীন স্ত্রী রোগ, বার্ধক্য, পাপের বিষ এবং বিদ্বেষ ছেড়েছিলেন। গ্রীক পুরাকথার মধ্যে নানারকম অভিশাপ ও নিষেধের কথা আছে, দোষী মানুষের শাস্তির কথা আছে। তবে গ্রীক পুরাকথা কিন্তু ধর্মীয় ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে ভারাক্রান্ত নয়, আবার রাজনৈতিক বিষয়ের ভাষ্য বা নীতিতত্ত্বের সহজপাঠও নয়। গ্রীকরা পুরোহিত শাসিত শহর রাজ্যের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনা করতেন। পুরোহিতগণ দেবতা বা বীরগণের বংশ থেকে উদ্ভুত বলে পরিচিত হতেন। গ্রীক পুরাকথার আর একটা লক্ষণীয় দিক হল এখানে কালের প্রভাবকে মাঝে মাঝে উপেক্ষা করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় ট্রয় অবরোধকালে দশ বছর এবং যুদ্ধের পরে আরও দশ বছর সময়কাল রাণী হেলেনের রূপ-লাবণ্য অপরিবর্তিত ছিল। একই ব্যাপার দেখি বাইবেলের পুরাকথার মধ্যেও, যেখানে সেরাহ্-র অপরূপ সৌন্দর্যের কথা বলা হয়েছে। সেরাহ নব্বই বছর বয়সেও সন্তানধারণ করেছেন (আইজ্যাকের জন্ম দিয়েছেন), সন্তানকে বুকের দুধ খাইয়েছেন। তাতে তাঁর সৌন্দর্যের হানি হয় নি। সময় ও সমসাময়িকতা এখানে পাশাপাশি অবস্থান করছে।
গ্রীক ও রোমান মিথের মধ্যে ভাগ্যের ধারণা ছিল না। ভার্জিল, লিভি ও অপরাপর অগাষ্টান প্রচারবাদীদের হাত ধরেই এই ধারণা প্রবর্তিত হয়েছিল। কোন কোন গবেষক অ্যানেইড ও এক্সোডাসের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পেয়েছেন যার থেকে মনে হয় ভার্জিল এই উপাদানটি ইহুদিদের কাছ থেকেই সংগ্রহ করেছিলেন। রোমান নীতিকথাগুলো কিন্তু ইহুদিদের নীতিকথার থেকে পুরোপুরি আলাদা। হিব্রু মিথের দুটি বৈশিষ্ট্য হল এগুলি মূলগতভাবে পিতৃতান্ত্রিক ও একেশ্বরবাদী।। সেদিক থেকে বিচার করলে হিব্রু মিথ পাশ্চাত্য জীবনে খ্রীষ্টীয় আদর্শকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছিল এবং হিব্রু মিথ থেকে খ্রীষ্ট ধর্মাবলম্বীরা অনেক উপাদান সংগ্রহ করেছিলেন।
………০………
অংকন – পুণ্যতোয়া