।। এক।।
ট্র্যাজেডির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল নায়ক চরিত্র নির্মাণ। ট্র্যাজিক নায়ক চরিত্রটির মহত্ত্ব ও নৈতিক ক্রিয়াকলাপের উপর কাহিনীর সমুন্নতি অনেকটাই নির্ভর করে। ভারতীয় নাট্যতত্ত্ববিদেরা একটি বিশেষ জীবন দর্শনকে ভিত্তি করে আদর্শ নায়কের রূপরেখা অঙ্কন করেছেন। তাঁরা মানুষ ও সমাজের উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন নি। তাঁদের বিশ্বাস মানুষ ঈশ্বরের দ্বারা পরিচালিত হয় এবং নিয়তির দ্বারা তাড়িত হয়। শুধু তাই নয়, মানুষ অলৌকিক বা অতিপ্রাকৃত শক্তির বশীভূত এবং এর প্রভাবে তাদের জীবনে সুখ দুঃখ নেমে আসে। তাই আদর্শ নায়কের জীবনের নানা ক্রিয়াকলাপ ও সুখ-দুঃখ দৈব-নির্ভর।
ভরতমুনি তাঁর নাট্যশাস্ত্রে বলেছেন নায়ক হবে প্রখ্যাত, উদাত্ত, রাজবংশ সম্ভুত, দৈব-আশ্রয় প্রাপ্ত, নানা ক্ষমতা সংযুক্ত, ঋদ্ধি বা বিলাস প্রভৃতি গুণসম্পন্ন। তিনি চার ধরনের নায়কের কথা বলেছেন – ধীরোদাত্ত, ধীরোদ্ধত, ধীরললিত ও ধীরপ্রশান্ত। এদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হল ধীরোদাত্ত নায়ক। ভরতের মতে ধীরোদাত্ত নায়ক হবে রাজবংশ সম্ভুত, অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন, দৈব-আশ্রয় প্রাপ্ত, উদার ও মহান। এই নায়ক মহৎ চিত্তের অধিকারী এবং উদার চরিত্রের, যিনি ন্যায়ের জন্য সব কিছুই ত্যাগ করতে পারেন। ধীরোদাত্ত নায়কের আদর্শ উদাহরণ রাম। মহাভারতের ভীমসেন হল ধীরোদ্ধত শ্রেণীর নায়ক। সে ধীর ও তেজসম্পন্ন হলেও স্বভাবে উদ্ধত। ধীরললিত শ্রেণীর নায়ক রাজকার্যে উদাসীন হলেও বিলাসিতায় মগ্ন থাকে। এর উদাহরণ হল বৎসরাজ। ধীরপ্রশান্ত শ্রেণীর নায়ক ধীর এবং সুখ-দুঃখ সবেতেই তার প্রশান্ত ভাব। চারুদত্ত এই ধরণের নায়ক। এই তিন শ্রেণীর নায়কই রাজবংশ সম্ভুত বা ব্রাহ্মণ এবং তারা সংকটে দৈব অনুগ্রহ লাভ করে থাকে। সুতরাং দৈব-অনুগ্রহ প্রাপ্ত না হলে বা ঐশ্বরিক গুণ না থাকলে সংস্কৃত নাটকের নায়ক হওয়া সম্ভব নয়।
গ্রীর পণ্ডিত অ্যারিষ্টটলও নায়ক চরিত্রের রূপরেখা অঙ্কন করেছেন, কিন্তু তিনি এমন ব্যক্তির কথা বলেছেন যার জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটবেই। আর ট্র্যাজেডি যখন ঘটবেই তখন ট্র্যাজিক নায়কের দৈব-আশ্রয় প্রাপ্ত বা ঐশ্বরিক গুণসম্পন্ন হওয়ার কোনও দরকার নেই। কারণ সেই অবস্থা থেকে দেবতার কৃপা বা অলৌকিক শক্তির সাহায্যে সে নিজেকে বাঁচাতে পারবে না। তাছাড়া ট্র্যাজিক নায়ক কোনও অতিমানব বা দেবতা নয়। মর্তের মানুষ রূপে জন্ম নিয়ে সে কোনও ঐশ্বরিক লীলা দেখায় না। অ্যারিষ্টটলের মতে ট্র্যাজিক নায়ক হবে সুখে-দুঃখে গড়া একজন মানুষ, যদিও সে আর পাঁচজনের মতো সাধারণ মানুষ হবে না। সাধারণের থেকে ব্যতিক্রম বলেই সে একজন প্রখ্যাত ব্যক্তি, যে নৈতিক চরিত্রগুণধর্মের অধিকারী এবং মানবিক গুণসম্পন্ন। ট্রাজিক নায়কের নৈতিক চরিত্রগুণ প্রসঙ্গে অ্যারিষ্টটল বলেছেন সর্বপ্রথমে তাকে মোটামুটিভাবে ভালো মানুষ হতে হবে। সে হবে এমন একজন ব্যক্তি যে বিশিষ্টভাবে মহান বা ন্যায়পরায়ণ নয়, অতিমাত্রায় ভাল বা অতিমাত্রায় মন্দ নয়। এখানে অতি ভাল বলতে superman এবং অতি মন্দ বলতে utter villain বোঝানো হয়েছে। ট্র্যাজিক নায়ক হবে এই দু’য়ের মধ্যবর্তী একজন মানুষ। অ্যারিষ্টটল অতিমানবকে ট্র্যাজিক নায়ক হবার অনুপযুক্ত বলে মনে করেছেন, কারণ তার জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটার সম্ভাবনা নেই।
অ্যারিষ্টটলের ট্র্যাজিক নায়ক অতিমানব বা অলৌকিক শক্তির অধিকারী নয় এবং সে দৈবকৃপায় জীবনের সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে পারে না। তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, কামনা-বাসনা, ভোগলিপ্সা আছে। সামাজিক মানুষ হিসেবে সে মনে করে সমাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সামাজিক সমস্যা সমাধান করা তার জীবনের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। সেই সঙ্গে সে উচ্চাকাঙ্ক্ষী এবং মানুষের নেতা হতে চায়। সে নিজেকে যেমন ভালবাসে, তেমনই সমাজ ও রাষ্ট্রকে ভালবাসে। তার অন্যতম লক্ষ্য হল সমাজ ও রাষ্ট্রের নায়ক হওয়া। এই সব কারণের জন্য সে Hero বা খ্যাতনামা হয়। কিন্তু তা হতে গেলে তাকে Good ও Virtuous হতে হবে, অর্থাৎ নৈতিক চরিত্রধর্মের অধিকারী হতে হবে। নৈতিক চরিত্রধর্ম অর্জন করতে হয় সমাজ-জীবনের শিক্ষা থেকে এবং তার প্রয়োগ করে দেখাতে হয়।
মানুষের নৈতিক চরিত্রধর্মকে নির্দিষ্ট করতে হয় ন্যায় ও অন্যায় এই দু’য়ের নিরিখে। যে ব্যক্তি ন্যায়ের পক্ষ অবলম্বন করে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে কেবলমাত্র তাকেই নৈতিক চরিত্রধর্মসম্পন্ন মানুষ বলা যায়। যে ব্যক্তি তা করে না সে নৈতিক চরিত্রধর্মসম্পন্ন মানুষ হতে পারে না। এখানেই অতিমানবের সঙ্গে ট্র্যাজিক নায়কের পার্থক্য। অতিমানব সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে না, বরং সমস্যার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে বিচরণ করে এবং নিজের মহত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। অন্য দিকে ট্র্যাজিক নায়ক সামাজিক সমস্যার সমাধান করতে চায়। সে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে জিততে চায় এবং বৈষম্যহীন ন্যায়ের সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য তাকে আত্মোৎসর্গ করতে হতে পারে এটা জেনেই সে নির্ভীক চিত্তে ন্যায়ের জন্য সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়।
অতিমানব যতই তত্ত্বজ্ঞানী বা আধ্যাত্মিক চেতনাসম্পন্ন হোক না কেন, সামাজিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়তে নামলে তাকে সংকটে পড়তে হবে। জীবনসংগ্রাম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আধ্যাত্মিক জগতে আশ্রয় নিলে অতিমানব হওয়া যায়, কিন্তু নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন মানুষ হওয়া যায় না। তার জন্য সারা জীবন সামাজিক অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়। সুতরাং নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন মানুষ হওয়া অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার, কারণ যে কোনও মুহুর্তে পদস্খলন ঘটতে পারে। যারা সেই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় তারাই নায়ক হতে পারে। যেমন হয়েছে প্রমিথিউস বা হ্যামলেট। হ্যামলেট মানবিক বিষয় সংক্রান্ত কারণে দুনীর্তিপরায়ণ রাজার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিল। প্রমিথিউস সংগ্রাম করেছিল স্বৈরতান্ত্রিক দেবতার বিরুদ্ধে। তারা দুজনেই অন্যায়ের বিকুদ্ধে সংগ্রাম করে ন্যায়ের জন্য প্রাণ দিয়েছে।
অ্যারিষ্টটল বলেছেন নায়ককে অবশ্যই নৈতিক চরিত্রগুণের অধিকারী হতে হবে। সমাজের আদর্শ নায়কেরা হল ট্র্যাজিক নায়ক। নৈতিক চরিত্রগুণ হল একটি বিশেষ গুণ যাকে সমাজের বিভিন্ন সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে কার্যে প্রয়োগ করতে হয়। শুধু মহত্ত্ব থাকাটাই যথেষ্ট নয়, তাকে কার্যে প্রয়োগ করার ক্ষমতাও থাকা চাই। চরিত্রগুণধর্ম ব্যক্তিগত নয়, তা সমষ্টিগত ও সর্বজনীন। কারণ তা সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত। তাই একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব কখনই তার ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, তা সামাজিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত। এই অর্থে আদর্শ নায়ক কোনও নির্দিষ্ট ব্যক্তি নয়, সে হল সমাজের প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তি যার উদ্দেশ্য সমাজের নৈতিক মূল্যবোধকে উঁচুতে তুলে ধরা। জনগণের স্বার্থবিরোধী কাজকে সে অনৈতিক বলে মনে করে এবং তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।
আদর্শ নায়কের জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটবেই। কারণ তারা অনৈতিকতার বিরুদ্ধে লড়াই করবেই এবং তার ফলে বিরোধে জড়িয়ে পড়বেই। তাই আদর্শ নায়কের জীবনের ট্র্যাজেডি কোনও ব্যক্তিগত ব্যাপার নয়, তা সর্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধের সঙ্গে যুক্ত। কোনও সাধারণ ব্যক্তি বা অতিমানব ট্র্যাজিক নায়ক হতে পারবে না, কারণ তাদের পক্ষে আদর্শ নায়ক হওয়া সম্ভব নয়। একই কারণে কোনও দুর্জন ব্যক্তিও আদর্শ নায়ক হতে পারবে না।
সংস্কৃত নাটকের করুণরসের নায়ক কে হতে পারে? ভরতের মতে যে কোনও ব্যক্তি (বা সাধারণ মানুষ) করুণরসের নায়ক হতে পারে। এর কারণ যে কোনও ধরণের বিপর্যয়মূলক ঘটনাকে যদি করুণ রসাত্মক বলা হয়, তাহলে যে কোনও ব্যক্তির পক্ষেই তার নায়ক হওয়া সম্ভব। তার জন্য আদর্শ নায়ক হওয়ার দরকার নেই। তবে মনে রাখতে হবে যা কিছু করুণ তা-ই ট্র্যাজিক নয়। হেগেল বলেছেন – “Mere suffering is not tragic.” সুতরাং যে কোনও বিপর্যয়মূলক বা দুর্ভোগজনিত ঘটনাই ট্র্যাজিক ঘটনা নয়। ট্র্যাজিক নায়কের সঙ্গে করুণরসের নায়কের পার্থক্য এই সূত্রের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে। শূদ্রকের ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে চারুদত্ত ও বসন্তসেনার জীবনের দুর্ভোগজনিত ঘটনা করুণ হতে পারে, কিন্তু তার পরিণতি ট্র্যাজিক হবে না। করুণরসের নায়কের জীবনে বিপর্যয় ঘটে দুর্জনের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা, নয়তো আকস্মিক কারণে। কিন্তু ট্র্যাজিক নায়কের জীবনে বিপর্যয় ঘটে তার নিজের ক্রিয়াকলাপের দ্বারা, সে নিজেই নিজের জীবনের বিপর্যয়ের স্রষ্টা।
ট্র্যাজিক নায়কের জীবনে বিপর্যয়ের মূলে থাকে একটি নৈতিক প্রশ্ন। এই প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করেই তার হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত হয়। তার জীবনের বিপর্যয় হল নৈতিক বিপর্যয়। এবং তা কেবল ব্যক্তিগত বিপর্যয়ের স্তরেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রকৃতপক্ষে তা হল সর্বজনীন বিপর্যয়। তাই নৈতিক প্রশ্ন ছাড়া ট্রাজিক নায়কের জীবন কল্পনা করা যায় না। কিন্তু করুণরসের নায়কের জীবনের বিপর্যয়ের সঙ্গে নৈতিকতার প্রশ্ন জড়িয়ে নেই, কারণ তারা কোনও নৈতিক বিষয় নিয়ে সংগ্রাম করে না। তেমনই তাদের জীবনের বিপর্যয়ের জন্য তারা নিজেরা দায়ী নয়।
করুণরসের নায়ক যে কেউ হতে পারে, কিন্তু ট্র্যাজিক রসের নায়ক হওয়া সহজ নয়। ধ্রুপদী সংস্কৃত নাটক ‘নাগানন্দ’-র নায়ক জীমূতবাহন গরুড়ের অত্যাচারের হাত থেকে নাগদের রক্ষা করার মধ্য দিয়ে মহৎ হতে চেয়েছিল। কিন্তু তার নৈতিক বোধ সামাজিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, বরং তা ছিল আধ্যাত্মিকতার আলোয় উজ্জ্বল। যাদের জীবনে বিপর্যয় নেমে আসে বা যারা দুর্ভাগ্যের কবলে পড়ে তারা দৈবের অনুগ্রহ পায় নি বলেই এমনটা ঘটে। আবার এটাও হতে পারে যে তারা জেনে বা না-জেনে কোনও পাপ করেছে বলেই তাদের জীবনে বিপর্যয় ঘটেছে। সংস্কৃত নাটকে পাপ বা অভিশাপ ব্যতীত কোনও বিপর্যয় ঘটতে পারে না, যেমন ঘটেছে শকুন্তলার জীবনে। তাই করুণরসের নায়কের নৈতিক চরিত্র প্রকাশের খুব একটা অবকাশ নেই। ট্র্যাজিক নায়কের জীবনে অবশ্য পাপকর্ম বা অভিশাপের কারণে দুর্ভাগ্য নেমে আসে না। তার জীবনে বিপর্যয় ঘটে কোনও মারাত্মক ভুল করার জন্য এবং এই ভুলের সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত থাকে একটি নৈতিক প্রশ্ন। এখানেই ট্র্যাজিক নায়ক ও করুণরসের নায়কের মধ্যে মূলগত পার্থক্য।
।। দুই।।
নাটকের কাহিনিসৃষ্টির সঙ্গে চরিত্র এবং চরিত্রসৃষ্টির সঙ্গে অ্যাকশন ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। সামাজিক ন্যায়-নীতির প্রশ্নে চরিত্রের অ্যাকশন প্রমাণ করে সে ভালো না মন্দ। নৈতিক চরিত্রগুণধর্মসম্পন্ন ব্যক্তির উদ্দেশ্য হল সামাজিক কল্যাণসাধন এবং জনগণের স্বার্থকে বজায় রাখা। তাই তার অ্যাকশনের মধ্য দিয়ে সেই উদ্দেশ্যই প্রকাশ পাবে। ট্র্যাজিক নায়ক একজন নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন ব্যক্তি। সে জীবনকে মহৎ উদ্দেশ্যের অভিমুখে পরিচালিত করার লক্ষ্যে জীবনযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ফলে সমাজের অশুভ শক্তির সঙ্গে তার বিরোধ অবশ্যম্ভাবী। তার অ্যাকশন হল নৈতিক অ্যাকশন, যার মধ্য দিয়ে নিজের মহত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। যেমন প্রমিথিউস হল একজন মহৎ ট্র্যাজিক নায়ক। সে মানব জাতির কল্যাণের জন্য একটি নৈতিক অ্যাকশন করেছিল, যে কারণে তাকে সর্বশক্তিমান দেবতা জিউসের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। প্রমিথিউস মানুষ হয়েও দেবতাদের বিরুদ্ধে আপোসহীন সংগ্রাম করেছিল এবং আত্মসমর্পণ না করে নিজের মহত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। মানব-বিদ্বেষী দেবতা জিউসের বিরুদ্ধে তার এই বিদ্রোহ ছিল আদ্যন্ত নৈতিক বিদ্রোহ। পাশাপাশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে হ্যামলেট নিজের মহত্বকে প্রতিষ্টা করেছে।
অ্যারিষ্টটল বলেছেন ট্র্যাজিক নায়ক ভালো মানুষ হবেই এবং তার জীবনে বিপর্যয় কোনও পাপাচারের ফলে ঘটবে না। তার জীবনে বিপর্যয় ঘটবে নিজের কোনও ভুল অ্যাকশনের জন্য। ট্র্যাজিক অ্যাকশন হল এমন নাটকীয় অ্যাকশন যা একাধারে অভাবনীয়, অপ্রত্যাশিত এবং অনিবার্য। এক জটিল বিরোধী পরিস্থিতির মধ্যে নায়ক এরকম অ্যাকশন করে বসে যা তার জীবনের চূড়ান্ত বিপর্যয়কে ডেকে আনে। এই ধরনের অভাবনীয় ও অপ্রত্যাশিত অ্যাকশনকে বলে ‘dramatic action’ এবং এটাই শেষ পর্যন্ত ‘tragic action’ হয়ে দাঁড়ায়। এরকম অ্যাকশনকে আমরা ট্র্যাজিক বলতে পারি মূলত দু’টি কারণে – প্রথমত নিজেরই প্রিয়জনের বিরুদ্ধে ভয়ানক অ্যাকশন করার জন্য, এবং দ্বিতীয়ত নায়ক ভুল করে তা করে বসে বলে। তাই ট্র্যাজিক অ্যাকশন হল মারাত্মক ভুল অ্যাকশন। শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডির চরিত্রদের মধ্যে ম্যাকবেথ, কিং লিয়র, ওথেলো, ব্রুটাস, প্রভৃতির জীবনে এটাই ঘটেছে।
ম্যাকবেথ খুব ভাল করেই জানত যে রাজা ডানকানের মতো সম্মানিত ব্যক্তিকে বাড়িতে অতিথি হিসেবে নিমন্ত্রণ করে এনে হত্যা করা জঘন্য অপরাধ। তা সত্বেও লেডি ম্যাকবেথের প্ররোচনায় তার মনের মধ্যে রাজা হওয়ার বাসনা এমন প্রবল হয়ে ওঠে যে সে ডানকানকে হত্যা করে বসল। এক জটিল পরিস্থিতির মধ্যে সে এই ধরনের অ্যাকশন করেছিল যা একদিকে যেমন অপ্রত্যাশিত, অন্যদিকে তেমনই অনিবার্য। ঠিক একইভাবে রাজা লিয়র একটি নাটকীয় অ্যাকশন করেছিল। কন্যা কর্ডেলিয়ার প্রতি সে এমন এক দুর্ব্যবহার করে বসল যা অভাবনীয় এবং অপ্রত্যাশিত। কিন্তু তা অনিবার্যও বটে, কারণ তার মাত্রাতিরিক্ত আত্মগর্বীভাব এবং জটিল পরিস্থিতি। তার অন্য দুই কন্যা চাটুকারিতার দ্বারা সেই আত্মগর্বীভাবকে এমনভাবে বাড়িয়ে তুলেছিল যে কর্ডেলিয়ার অত্যন্ত সঙ্গত কথাও তার কাছে অসঙ্গত ঠেকেছিল। রাজা লিয়রের এই মারাত্মক অ্যাকশন শুধু কর্ডেলিয়ার জীবনেই নয়, তার নিজের জীবনেও ট্র্যাজেডি বয়ে এনেছিল। ওথেলো তার স্ত্রী ডেসডিমোনার সতীত্বের প্রতি সন্দেহ করে তাকে হত্যা করে বসেছিল। ওথেলোর এই ভয়ংকর অ্যাকশন করার পিছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, তার নিজের মনে বাসা বাঁধা সন্দেহ। দ্বিতীয়ত, তার আসে-পাশের বন্ধুরা তাকে এমনভাবে প্ররোচিত করেছিল যে সেই সন্দেহ দৃঢ়তর হয়। তার ফলে সে এই ভয়ংকর আচরণ করতে বাধ্য হয়। ব্রুটাসের মনে এমন একটা ধারণা অস্পষ্টভাবে ছিল যে সীজার গণতন্ত্র বিরোধী কাজ করেছে। সেই ধারণা স্পষ্টতর হয়েছিল এমন সব লোকেদের কথায় যাদের ব্রুটাস গণতন্ত্রের অনুরাগী বলে মনে করেছিল। তাদের কথায় প্রভাবিত হয়ে সে সীজারকে হত্যা করে বসল।
পাশ্চাত্য নাট্যতত্ত্ববিদদের মতো ভারতীয় নাট্যতত্ত্ববিদরা অ্যাকশনের তত্ত্ব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেননি। সংস্কৃত নাটকের নায়কদের সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কোনও অ্যাকশন করতে দেখা যায় না। পাশ্চাত্যের নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন ব্যক্তির ধারনার থেকে ভারতের নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন ব্যক্তির ধারনার মূলগত তফাতের মধ্যেই এর কারণ লুকিয়ে আছে। পাশ্চাত্যের ধারনায় নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন ব্যক্তি হল – man of action। পাশ্চাত্য নাটকের নায়ককে মানব জাতির সামাজিক স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগ্রামের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। সংস্কৃত নাটকের নায়করা হল রাজন্যশ্রেণীর, তাদের এই ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রয়োজন হয় নি। তাই তাদের বলা যায় – man of no action। যেমন ‘মৃচ্ছকটিক’ নাটকে চারুদত্ত নিজের উদ্দেশ্যের জন্য কিছু করেনি, তার সঙ্গে বসন্তসেনার প্রেমের ব্যাপারে যা কিছু ঘটেছে সবই বাইরে থেকে। ভবভূতির ‘উত্তররামচরিত’ নাটকে রাম ও সীতার বিচ্ছেদের ঘটনা রামের অ্যাকশনের জন্য হয়নি, তা ঘটেছে জনগণের অপবাদ দেওয়ার জন্য।
করুণরসের নায়ক হবে নিষ্ক্রিয়। তার জীবনে বিপর্যয় ঘটবে দুর্জনের ভয়ংকর অ্যাকশনের ফলে। করুণরসের ভাব হল শোক, যার ফলে চোখের জল ফেলা অবশ্যম্ভাবী। করুণরসের সঙ্গে রৌদ্ররসের সম্পর্ক আছে। ভরতের মতে রৌদ্ররসের স্থায়ীভাব হল ক্রোধ। রৌদ্ররসের নায়কেরা দুর্জন, বর্বর ও উদ্ধত প্রকৃতির এবং এদের অ্যাকশনই এই রসের প্রধান বিষয়। আসলে উদ্ধত প্রকৃতির দুর্জনরা ধার্মিক মানুষদের জীবনে বিপর্যয় নিয়ে আসে। যেমন রাম-সীতার জীবনে রাবণ অশান্তি নিয়ে এসেছে, যুধিষ্ঠিরাদি পাণ্ডবদের জীবনে দুর্যোধন ও অন্যান্য কৌরবরা দুর্ভোগ ডেকে এনেছে।
রৌদ্ররসের নায়করা ক্রোধোন্মত্ততার ফলে যে অ্যাকশন করে তার প্রকৃতি নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। কিন্তু বীররসের নায়কদের ক্রোধ এবং রৌদ্ররসের নায়কদের ক্রোধ এক রকম নয়। বীররসের নায়কদের মূল ভাব উৎসাহ, আর রৌদ্ররসের নায়কদের মূল ভাব ক্রোধ। রৌদ্ররসের নায়কদের ক্রোধ জাগে নীচ ভাবনা থেকে, তাদের ক্রোধের প্রকৃতি হল নীচ। অন্য দিকে বীররসের নায়কদের ক্রোধের প্রকৃতি হল উত্তম। যেমন মহাভারতের ভীমসেন উদ্ধত প্রকৃতির হলেও ধীর, তাই সে ধীরোদ্ধত শ্রেণীর নায়ক। বীভৎস অ্যাকশন (যেমন দুঃশাসনের রক্তপান) করলেও তাকে রৌদ্ররসের নায়ক বলা যাবে না, কারণ তা বর্বর ও দুর্জনদের বিরুদ্ধে করা হয়েছে। তাইতার উদ্দেশ্য মহৎ ও ক্রোধ উত্তম প্রকৃতির।
বীররসের নায়কদের সঙ্গে রৌদ্ররসের নায়কদের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে। এই সম্পর্কের কারণে বীররসের নায়কদের তিন শ্রেণীতে ভাগ করা হয় – দানবীর, কর্মবীর এবং যুদ্ধবীর। দানবীর নায়কের উদাহরণ কর্ণ, ধর্মবীর নায়কের উদাহরণ যুধিষ্ঠির এবং যুদ্ধবীর নায়কের উদাহরণ অর্জুন। বীররসের নায়ক সর্বদা যুদ্ধ ও সংগ্রামে সন্তুষ্টি লাভ করে। তা সত্বেও বীররসের নায়কের ক্রোধ উত্তম প্রকৃতির এবং রৌদ্ররসের নায়কের ক্রোধ অধম প্রকৃতির। সমালোচকের মতে বীররসের ক্রোধ হল ভাবাবেগ এবং রৌদ্ররসের ক্রোধ হল জান্তব।
এই প্রসঙ্গে পাশ্চাত্য নাটকের নায়কদের সঙ্গে বীররস ও রৌদ্ররসের নায়কদের তুলনা করা যেতে পারে। অ্যাগামেনন, ইউলিসিস, হেক্টর, প্রমিথিউস, অ্যাজাক্স, ম্যাকবেথ, ওথেলো, জুলিয়াস সীজার, ব্রুটাস, এ্যান্টনি প্রভৃতি ইউরোপীয় নায়করা তাদের বীরোচিত কার্যকলাপের জন্য বিখ্যাত। কিন্তু তার মানে কেবলমাত্র যুদ্ধে জয়লাভ করা বোঝায় না। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য হল গৌরব ও খ্যাতি অর্জন করা। বীরধর্মের বৈশিষ্ট্য হল যশোলাভ এবং বিখ্যাত হওয়ার জন্য আবেগ। এ আবেগ হল নৈতিক আবেগ যার মূলে আছে জাতির স্বার্থরক্ষার প্রয়াস। নিজের স্বার্থের চেয়ে সমষ্টিগত স্বার্থ রক্ষা করাই তার উদ্দেশ্য। সুতরাং বীর নায়কেরা যুদ্ধে জয়ী হবার জন্য নিজের জীবনকে বিপদের মুখে ফেলতেও পিছপা নয়। এদের মধ্যেও ক্রোধজনিত আবেগ আছে, কারণ এরা আবেগমুক্ত মানুষ নয়।
ট্র্যাজিক নায়ক হল বীরপুরুষ এবং মধ্যপন্থার মানুষ। সে অতিরিক্ত ক্রোধসম্পন্ন ব্যক্তি নয়। তাই ক্রোধের বশে সে কিছু করে বসলে সেই ভয়ংকর অ্যাকশনকে হঠকারী মানুষের অ্যাকশন বলা যায় না। সে একজন আদ্যন্ত নৈতিক চরিত্রগুণসম্পন্ন মানুষ এবং তার প্রতিটি অ্যাকশন সামাজিক কল্যাণের ভাবনায় ও আবেগে পরিচালিত। তাই তাকে অশুভ শক্তির সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয়। ট্র্যাজিক নায়ককে অনেক সময় রাজনৈতিক বিরোধে জড়িয়ে পড়তে হয় বটে, কিন্তু এর মধ্যে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম থাকলেও কোনও ট্র্যাজেডি নেই। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ, রাম-রাবণের যুদ্ধ, এথেন্সের যুদ্ধ বা ওয়াটারলুর যুদ্ধ প্রভৃতি যুদ্ধের মধ্যে কোনও ট্র্যাজিক অ্যাকশন খুঁজে পাওয়া যায় না। ট্র্যাজিক অ্যাকশন ঘটে প্রিয়জনের সঙ্গে প্রিয়জনের বিরোধ থেকে এবং তা রণক্ষেত্রের অ্যাকশনের থেকেও ভয়াবহ। তবু সেটা রৌদ্ররসের নায়কের মত ইচ্ছাকৃত অ্যাকশন বা ব্যক্তিস্বার্থ পূরণের জন্য পরিকল্পনা করে বীভৎস অ্যাকশন নয়।
অ্যারিষ্টটল বলেন কোনও ব্যক্তি যদি নিজের মতলব মতো কাজ করে তাহলে সে অন্যায়কারী এবং বদ স্বভাবের লোক। এরা মতলববাজ এবং সর্বদা নিজের ব্যক্তিস্বার্থের কথা মাথায় রেখে কাজ করে। কিন্তু ট্র্যাজিক নায়ক কোনও মতলব নিয়ে বা ব্যক্তিস্বার্থ সিদ্ধির জন্য ভয়ানক অ্যাকশন করে না। ওথেলো, ব্রুটাস, কিং লিয়র প্রভৃতিরা কেউই নিজের স্বাথসিদ্ধির জন্য কাজ করেনি। এরা যাদের বিরুদ্ধে ভয়ানক অ্যাকশন করেছে তাদের অন্যায়কারী বলে ভেবেছিল, যদিও সেই ভাবনা ছিল ভুল। তাই ট্র্যাজিক নায়ক যখন কোনও ভুল অ্যাকশন করে তখন তারা নৈতিক বোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং আবেগতাড়িত হয়ে তা করে বসে। যেমন ওথেলো ভেবেছে ডেসডিমোনা অসতী, ব্রুটাস ভেবেছে সীজার স্বৈরতন্ত্রী এবং রাজা লিয়র ভেবেছে কর্ডেলিয়া গর্বোদ্ধত ও কোমলতাবিহীন। সুতরাং ট্র্যাজিক নায়ক এক রকম ভেবে অ্যাকশন করে, আর কার্যক্ষেত্রে হয় অন্য রকম। এই অর্থে তাকে শয়তান বা রৌদ্ররসের নায়ক কোনওটাই বলা যায় না।
ইউরোপীয় ট্র্যাজিক নায়ককে সংস্কৃত নাটকের বীররসের নায়ক বলা চলে না। কারণ বীররসের নায়করা প্রিয়জনের সঙ্গে কোনও বিরোধে জড়িয়ে পড়েনি বা ট্র্যাজিক অ্যাকশনও করেনি। যেমন বাসবদত্তার সঙ্গে রাজা বৎসের বিরোধ গুরুতু আকার ধারণ করেনি। রাজা বৎস যে সাগরিকার সঙ্গে প্রেমে আবদ্ধ সে কথা জেনেও বাসবদত্তা বিরোধে জড়িয়ে পড়েনি। আসলে এই প্রেমের মধ্যে তীব্রতা বা গভীরতা ছিল না, তা দৈহিক মিলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এর মধ্যে কোনও নৈতিক প্রশ্ন জড়িত ছিল না বলে বিরোধ বা ভয়ংকর অ্যাকশনের প্রয়োজনীয়তাও ছিল না। পক্ষান্তরে গ্রীক নাটকের নায়িকা মিডিয়া তার স্বামীর অন্য নারীর প্রতি আসক্তিকে একেবারেই সহ্য করতে পারেনি। সে তীব্র বিরোধিতা করেছে এবং সন্তান হত্যা করে নিজের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। এটাই হল সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে পাশ্চাত্য নাটকের নায়ক-নায়িকাদের তফাত, যার মূলে আছে নৈতিকতাবোধের পার্থক্য।
ট্র্যাজিক অ্যাকশন নৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ভুত, অথচ যে নৈতিক বোধ থেকে ভয়ংকর অ্যাকশন করা হয় তা পরে ভুল বলে প্রমাণিত হয়। আসলে অ্যাকশনটি ভুল বলেই তো ট্র্যাজিক বলে আখ্যা পেয়েছে। ট্র্যাজিক নায়কের অ্যাকশন মুহূর্তের অন্ধ আবেগজনিত ভুল হতে পারে, কিন্তু রৌদ্ররসের নায়কের মতো স্বভাবজনিত নয়। ট্র্যাজিক নায়কের অ্যাকশন স্বভাবগত নয় বলে তা অপ্রত্যাশিত ও অনিবার্য, কিন্তু রৌদ্ররসের নায়কের অ্যাকশন স্বভাবগত বলে তা প্রত্যাশিত। এখানেই ট্র্যাজিক নায়কের সঙ্গে রৌদ্ররসের নায়কের তফাত।
।। তিন।।
ট্র্যাজিক অ্যাকশন নিঃসন্দেহে ভুল অ্যাকশন যা নায়কের জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটায়। কিন্তু নায়ক তো ইচ্ছে করে ভুল অ্যাকশন করেনি। যখন সে ভয়ংকর অ্যাকশনটি করেছিল তখন সে নিশ্চিত ছিল যে তা সঠিক। পরে তার কাছে ধরা পড়ে যে সে ভুল অ্যাকশন করেছে। অথচ সে কোনওদিন ভাবেনি যে তার প্রিয়জনের বিরুদ্ধেই তাকে ওই ধরনের মারাত্মক অ্যাকশন করতে হবে। নায়কের লক্ষ্য একটি পরিপূর্ণ সুখী জীবন যাপন করা। সেই সুখ রাজনৈতিক, সামাজিক ও পারিবারিক জীবনের মিলিত সুখ। কোনও একটি বিশেষ সুখ তার কাম্য নয়। ওথেলো রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সুখী হয়েছিল এবং চেয়েছিল ডেসডিমোনাকে নিয়ে সুখী পারিবারিক জীবন কাটাতে। রাজা লিয়র চেয়েছিল বৃদ্ধ বয়সে সব দায়-দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে সুখী জীবন যাপন করতে। কিন্তু তারা সেই পরিপূর্ণ সুখী জীবন পায়নি।
এখানে প্রশ্ন ওঠে পরিপূর্ণ সুখী জীবন উপভোগ করা কি সম্ভব? মহৎ ব্যক্তিদের জীবন থেকে দেখা যায় তা সম্ভব নয়। একজন ব্যক্তি জীবনে আংশিক সুখ লাভ করতে পারে, কিন্তু পরিপূর্ণ সুখ লাভ করা অত্যন্ত কষ্টকর। ট্র্যাজিক নায়ক একজন মহৎ মানুষ। তার মনে পরিপূর্ণ সুখের বাসনা জাগতেই পারে এবং সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সে এগোতে চায়। কিন্তু কেন তার জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটে? এ বিষয়ে অ্যারিষ্টটলের বক্তব্য হল – “Misfortune is brought about not by vice or depravity, but by some error or fraity.” তিনি বলতে চেয়েছেন পাপাচার বা শয়তানির ফলে ট্র্যাজিক নায়কের জীবনে বিপর্যয় ঘটে না, তা ঘটে ভুলের কারণে বা স্বভাবগত দুর্বলতার জন্য।
ট্র্যাজিক নায়ক প্রসঙ্গে গিলবার্ট মুরে বলেন – “The typical tragic hero is one who falls from high state of fame, not through vice and depravity, but by some great hamartia. Hamartia means originally a ‘bad shot’ or ‘error’ but is currently used for ‘offence’ or ‘sin’.” আধুনিক পণ্ডিতরা হ্যামারসিয়া শব্দটির অর্থ হিসেবে ‘ভুল’-কে মেনে নিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু ‘ভুল’ শব্দটির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা হল ‘ভাগ্য’। এর কারণ তাঁরা মনে করেন ট্র্যাজিক নায়ক হল নিয়তির শিকার, নিয়তির হাতে সে অসহায়। সব পণ্ডিতই অবশ্য নিয়তিবাদে বিশ্বাসী নন। যেমন এফ. এল. লুকাস মনে করেন অন্ধের মতো ভুল পদক্ষেপ নেওয়ার ফলেই নায়ক-নায়িকার জীবনে বিপর্যয় ঘটে। নিকোলাই ওকলপকভ অভিমত প্রকাশ করেছেন – “Knowledge of the world affirms that man is not a plaything in the hands of mysterious spirits, that his fate is in his own hands, depends upon his own efforts, is achieved by struggle.” অ্যারিষ্টটল কিন্তু কোথাও বলেননি যে দৈব, ভাগ্য বা নিয়তির জন্য ট্র্যাজিক নায়কের জীবনে বিপর্যয় নেমে এসেছে। বরং তিনি মানুষের অ্যাকশনের উপরেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে – “It is in our action – what we do that we are happy or just the reverse.” তাই তিনি ভাগ্য-বিড়ম্বনার জন্য মানুষকেই দায়ী করেছেন। এই কথারই প্রতিধ্বনি হেগেল-এর বক্তব্যে – “The character that is dramatic plucks for himself the fruit of his own deed.” ট্র্যাজিক নায়ক নিজেই নিজের কর্মের ফল ভোগে এবং স্বখাত সলিলে ডুবে মরে।
কিন্তু ট্র্যাজিক নায়ক ভয়ংকর অ্যাকশন করে বসে কেন? ডেসডিমোনাকে হত্যা করার আগে ওথেলো নিশ্চিত ছিল যে সে অসতী। তাই সে নিজের হাতে অসতীকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। রাজা লিয়র কন্যা কর্ডেলিয়াকে শাস্তি দিয়েছিল এই ভেবে যে সে অহংকারী, দাম্ভিক এবং তাকে মান্য করে না। ব্রুটাস অন্তরঙ্গ বন্ধু হয়েও সীজারকে হত্যা করেছিল এই ভেবে যে সে স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। সুতরাং ট্র্যাজিক নায়কেরা নৈতিক কারণে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভয়ংকর অ্যাকশন করে বসে এবং পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে। যেমন ওথেলো পরে বুঝেছিল ডেসডিমোনাকে হত্যা করা ভুল হয়েছিল। কারণ ডেসডিমোনা সত্যিই অসতী ছিল না, যদিও সে তাকে অসতী ভেবেই হত্যা করেছিল। রাজা লিয়র পরে বুঝেছিল কর্ডেলিয়াকে শাস্তি দেওয়া ভুল হয়েছিল। কারণ কর্ডেলিয়া সত্যিই দাম্ভিক, আত্মগর্বী ও কোমলতাবিহীন ছিল না, যদিও রাজা লিয়র তাকে ওই রকমই ভেবেছিল। একইভাবে ব্রুটাস পরে বুঝেছিল যে সীজারকে হত্যা করা ভুল হয়েছিল। কারণ সীজার সত্যিই স্বৈরতান্ত্রিক ছিল না, যদিও ব্রুটাস তাকে সেই রকমই ভেবেছিল।
এখানে প্রশ্ন ওঠে ট্র্যাজিক নায়ক কেন এই ধরণের মারাত্মক ভুল করে? ট্র্যাজিক নায়ক উচ্চ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন এবং মহৎ নৈতিক চরিত্রগুণের অধিকারী। নিঃসন্দেহে সে সাধারণ মানুষদের থেকে ব্যতিক্রম। তা হলেও আসলে সে তো একজন মানুষ; তার মধ্যেও সংস্কার, বিশ্বাস, ঈর্ষা, ক্রোধ, মান-অভিমান, অহংবোধ প্রভৃতি আবেগ আছে। যে সম্প্রদায়ে, সমাজে, রাষ্ট্রে সে বাস করে তার কিছু সংস্কার ট্র্যাজিক নায়কের মনে প্রভাব ফেলে। এই প্রভাবকে সে একেবারে পরিত্যাগ করতে পারে না। একজন পরিবেশ প্রভাবিত জীব হওয়ার কারণে তার উপর পরিবেশের প্রভাব পড়াটাই স্বাভাবিক।
এই প্রসঙ্গে শেক্সপীয়রের বিখ্যাত ট্র্যাজিক নায়ক ওথেলোর কথা উল্লেখ করব। সে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও নিজের সম্প্রদায়ের সংস্কারকে ভুলতে পারেনি। ইউরোপীয় সমাজে প্রচলিত নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশাকে মন থেকে মেনে নিতে পারেনি বলেই সে ডেসডিমোনার চরিত্রের প্রতি সন্দিহান হয়ে পড়েছিল, যা তার জীবনে ট্র্যাজেডি ঘটার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। তা ছাড়া নিজের সম্প্রদায়ের সংস্কার তার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তার মা তাকে একটি রুমাল দিয়ে বলেছিল সেটা স্ত্রী-কে উপহার দিতে। যতক্ষণ ওই রুমালটা তার স্ত্রী-র কাছে থাকবে ততক্ষণ সে সতী থাকবে, কিন্তু রুমালটা অন্য পুরুষের কাছে গেলেই বুঝতে হবে যে সে অসতী হয়েছে। এই কুসংস্কার ওথেলোর মনের ভিতর বাসা বেঁধে ছিল। তাই বিয়ের পর সে ডেসডিমোনাকে রুমালটা উপহার দিয়েছিল, কিন্তু তার পিছনের কারণটা বলেনি। যখন সে রুমালটা ক্যাসিওর ড্রয়ারে দেখল তখনই তার সন্দেহ প্রবল হয়ে উঠল এবং ডেসডিমোনাকে অসতী ভেবে হত্যা করল। এর থেকেই বোঝা যায় কুসংস্কার বা অবিশ্বাস মানুষের জীবনে কী ভয়ংকর ভূমিকা নেয়।
রাজা লিয়র তার কন্যা কর্ডেলিয়াকে কঠিন শাস্তি দিয়েছিল এরকমই এক সংস্কারের বশে। লিয়রের মধ্যে অহংবোধ ও প্রভুত্বের সংস্কার যুগপৎ ক্রিয়াশীল ছিল। দীর্ঘকাল যাবৎ শাসক থাকার ফলে তার মনের ভিতর প্রভুত্বের সংস্কার বাসা বেঁধে ছিল। চিরকাল সকলে তার প্রভুত্বের কাছে মাথা নত করেছে এবং মন যোগানোর জন্য চাটুকারিতা করেছে, যেমন করেছিল তার অপর দুই কন্যা গনেরিল ও রিগান। লিয়র মনে মনে কর্ডেলিয়াকে সব থেকে বেশি ভালোবাসত এবং তার কাছ থেকেও সেরকমই প্রশংসাবাক্য ও চাটুকারিতা আশা করেছিল। কিন্ত কর্ডেলিয়া তা করেনি বলে রাজার অহংবোধে আঘাত লেগেছিল। তাই সে কর্ডেলিয়াকে দাম্ভিক ও আত্মগর্বী ভেবে রাজ্য ভেবে নির্বাসিত করেছিল।
সুতরাং কেউই সংস্কার থেকে মুক্ত নয়, তা সে যত বড় ব্যক্তিই হোক। একই ভাবে যে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা মানুষের মনে অহংবোধ জাগিয়ে তোলে তার থেকে মুক্ত হওয়াও সহজ নয়। প্রকৃতপক্ষে ত্রুটিমুক্ত নায়ক খুঁজে পাওয়া শক্ত। পাশাপাশি এটাও সত্য যে মানুষের মধ্যে আবেগ থাকবেই। মানুষ যখন আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে তখন সে হয় সংযত ও যুক্তিভিত্তিক। আর আবেগ যখন মানুষকে পরিচালিত করে তখন সে হয় অসংযত, অসংলযগ্ন ও যুক্তিহীন। কিন্তু মানুষ কি সব সময়েই আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে? উত্তরে বলা যায় সকলে না পারলেও মহৎ মানুষ পারে। সেই জন্যই তো সে আবেগের বশীভূত হয় না, বহু বিপদের মধ্যে দিয়ে গেলেও অধ্যবসায়ের সাহায্যে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে কোনও এক মুহুর্তে যদি সে আবেগের বশীভূত হয়ে পড়ে তখন মারাত্মক ভুল করে বসে।
আবেগের শিকার হয়ে পড়াটা মহৎ মানুষের কাছে অপ্রত্যাশিত। তার মনের মধ্যে যে সংস্কার সুপ্ত আছে সেটাই এর জন্য দায়ী। তা ছাড়া এ ব্যাপারে তৃতীয় ব্যক্তির অবদান আছে। সমাজে ভাল এবং মন্দ উভয়বিধ ব্যক্তি আছে এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্বও আছে। অ্যারিষ্টটল বলেছেন – “Goodness is one, evil is multiform.” পিথাগোরাসের পরিভাষা অনুযায়ী মন্দ হল অসংখ্য প্রকারের, আর ভাল হল সীমিত। যেহেতু সমাজে প্রচুর অশুভ শক্তির উপস্থিতি, তাই শুভ শক্তির পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো কঠিন। অশুভ শক্তির কাজ হল এমন অবস্থার সৃষ্টি করা যাতে মহৎ ব্যক্তি তার পথ থেকে বিচ্যুত হয়।
মহৎ ব্যক্তিকে মন্দ লোকের কবলে পড়তেই হয়। কারণ সে চিনতে ভুল করে কে ভালো লোক আর কে মন্দ লোক। মন্দ ব্যক্তি যেন এক সার্থক ও দক্ষ অভিনেতা। কথায়-বার্তায় আচার-আচরণে সে এমন ভাবে মন জয় করে যে মহৎ ব্যক্তির তার প্রতি সামান্যতম সন্দেহ হয় না। সে মহৎ ব্যক্তির দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তার জীবনে ফাটল ধরিয়ে দেয়। এইভাবে শয়তানেরা মহৎ ব্যক্তির ক্ষতি করে নিজের স্বার্থসিদ্ধির লক্ষ্যে এগোতে চায়। শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডিতে এরকম দক্ষ শয়তান চরিত্রের দেখা মেলে। যেমন ওথেলো নাটকের ইয়াগো, কিং লিয়র নাটকে গনেরিল ও রিগ্যান এবং জুলিয়াস সীজার নাটকের ক্যাসিয়াস।
এ বিষয়ে কোনও দ্বিমত নেই যে ট্র্যাজিক নায়ক নিজেই তার জীবনে বিপর্যয়ের জন্য দায়ী, কারণ সে ভয়ংকর ভুল অ্যাকশন করেছে। কিন্তু সমাজের অশুভ শক্তি তার থেকে কম দায়ী নয়। সমাজের অশুভ শক্তি বন্ধুর ভেক ধরে নায়কের কাছে আসে এবং তাকে ভুল করতে প্ররোচনা দেয়। এই শয়তানদের প্ররোচনায় নায়ক অন্ধ আবেগে দ্বারা পরিচালিত হবেই এবং ভুল অ্যাকশন করবেই। এই ভুল করার পিছনে কোনও দৈব, নিয়তি বা ভাগ্য নেই; আসলে নায়কের ভুলের জন্য দায়ী কঠিন কঠোর সমাজ। কারণ সমাজই নায়কের মনে সংস্কার ও বিশ্বাসের বীজ রোপণ করে এবং সেই ধারনা লালন করে।
।। চার।।
ট্র্যাজেডির নায়কের ভুলের মধ্যে কতটুকু মানবীয় মহত্ব আছে? আমরা দেখেছি ট্র্যাজিক নায়ক সচরাচর অত্যন্ত বিখ্যাত ব্যক্তি এবং নৈতিক চরিত্রগুণের অধিকারী। তার লক্ষ্য হল দ্বিবিধ – সামাজিক কল্যাণ এবং সুখী জীবন যাপন করা। কিন্তু সমাজ জীবনের অশুভ শক্তির প্রভাবে সে চরম সংকটের মুখেমুখি হয়। এই অশুভ শক্তি হল সমাজের শয়তান ব্যক্তিরা, যারা নায়কের কোনও চারিত্রিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাকে ভুল পথে চালিত করে। এর ফলে অন্ধ আবেগের তাড়নায় নায়ক বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে প্রিয়জনকে নিষ্ঠুর আঘাত করে বসে। কিন্তু পরে যখন নায়ক জানতে পারে যে সে মারাত্মক ভুল করেছে, তখন সে এক অপ্রত্যাশিত ও অদ্ভুত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়। এটা তার জীবনের সব থেকে বিপজ্জনক অবস্থা।
যেমন শেক্সপীয়রের ট্র্যাজেডির নায়ক ওথেলো জানতে পেরেছিল যে ডেসডিমোনা অসতী নয়। আসলে ইয়াগো রুমাল চুরি করে ক্যাসিওর ড্রয়ারে রেখে তাকে ভুল বুঝিয়েছে এবং সেই ভুল বোঝার ফলে সে ডেসডিমোনাকে হত্যা করেছে। তখন নিজের ভুল কাজের স্বরূপ বুঝতে পেরে সে বিস্মিত হয় এবং বিবেকের দংশনে ভোগে। সে নিজের মূঢ়তায় লজ্জিত হয় ও তীব্র অনুশোচনায় জর্জরিত হয়। এই পরিস্থিতিতে ওথেলোর সামনে দু’টি পথ খোলা ছিল। যে শয়তান তাকে ভুল পথে পরিচালিত করেছে হয় তার বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে, অথবা এমন একটা কিছু মানবীয় কাজ করবে যাতে এই ভয়ংকর ভুলের জন্য যথাযথ মূল্য দেওয়া যায়। শেষ পর্যন্ত সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে মানবিক মূল্য দিয়ে এই ভয়ংকর ভুলের জবাব দেবে, কারণ ট্র্যাজিক নায়কের কাছে মানবীয় মূল্য হল সবচেয়ে বড়। ট্র্যাজিক নায়ক তো ধর্মস্থানে গিয়ে পাপ স্বীকার করে সারা জীবন অনুতাপে দগ্ধ হয়ে বাঁচতে চায় না, এতে তার মানবীয় মহত্বে বাধে। সে কোনও অপরাধীও নয় যে আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করবে। ট্র্যাজিক নায়ক নিজেই নিজের বিচার করে এবং স্বকৃত ভুলের জন্য পূর্ণ মূল্য দিতে প্রস্তুত হয়। তাই শয়তান ইয়াগোকে হত্যা করতে গিয়েও ওথেলো তাকে ঘৃণ্য জীব ভেবে ছেড়ে দেয়। নিজের ভুলের জন্য অনুতাপে দগ্ধ হয়ে সে হাহাকার করে ওঠে। তার হৃদয় আবার ডেসডিমোনার প্রতি ভালোবাসার দীপ্তিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং সেই ভালোবাসার আলোকে সে সঠিক পথ খুঁজে পায়। এখানেই ট্র্যাজিক নায়কের সার্থকতা।
ওথেলোর বিবেক প্রেমকে চিরন্তন করে রাখায় জন্য নতুন পথের দিশারী হয়েছিল। প্রেমের প্রবাহে তার হৃদয়ের কালিমা মুছে যায়। কারণ প্রেম হল চির-জ্বলন্ত অগ্নিশিখা, যা নৈতিক বোধ ও বিবেকের সঙ্গে যুক্ত। প্রেম থেকেই বিবেকের জন্ম এবং বিবেকই প্রেমকে চিরন্তন করে রাখার অঙ্গীকার করে। ওথেলো ডেসডিমোনাকে ভালোবাসার অঙ্গীকার করেছিল এবং তাকে সুখী জীবনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু তার নিজের ভুলেই তা তছনছ হয়ে যায়। তাই বলে ওথেলো বিশ্বাসঘাতক হতে পারে না, নিজের দেওয়া কথা সে রাখবেই। নিজের ভেতরের আবেগরূপী পশুকে বধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে সে বলে – “For, in my sense, it is happiness to die.” পৃথিবীর মানুষকে উদ্দেশ্য করে সে এই কথাটি মনে রাখতে বলে – “Of one that loved not wisely, but too well, of one not easily jealous, but being wrought, perplexed to the extreme.” ওথেলো মৃত্যু বরণ করে প্রেমের মর্যাদা রেখেছে। সে জীবনের মূল্য দিয়ে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। তাই সে শয়তান অপরাধী নয়, মহান হত্যাকারী। তার ভুল হল মহৎ ভুল, মানবীয় ভুল। জীবনের মূল্যে সে মারাত্মক ভুলের মাশুল দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করেছে। নিজের মহত্বের গৌরবকে অক্ষুণ্ণ রাখার যে অঙ্গীকার সে করেছিল তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। তাই মরার আগে সে বলেছে – “Ï kissed thee ere I killed thee, no way but this. Killing myself, to die upon a kiss.” (Act V, Scene II).
রাজা লিয়রের জীবনেও এরকমই ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটেছিল। তিনি কর্ডেলিয়াকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, কিন্তু তাকে বুঝতে পারেননি। তাই কর্ডেলিয়াকে ভুল বুঝে তিনি কঠিন শাস্তি দিয়েছিলেন। কিন্তু জীবনের দুঃখের দিনে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কর্ডেলিয়াকে শাস্তি দিয়ে কত বড় ভুল করেছিলেন! কারণ তাঁকে বাঁচাবার জন্যেই পরবর্তীকালে কর্ডেলিয়া প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। তখন রাজা লিয়র এই মর্মান্তিক ঘটনায় এমন প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন যে প্রিয়তমা কন্যার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। তিনি ঈশ্বরের নাম উচ্চারণ করেননি বা অন্য দুই কন্যা গনেরিল ও রিগানকে (যারা তাঁর জীবনের এই বিপযয়ের জন্য দায়ী) অভিশাপও দেননি। তিনি কর্ডেলিয়ার প্রাণহীন দেহের দিকে চেয়ে অনুতাপে দদ্ধ হয়েছিলেন। তিনি এই দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত নিজেকেই দায়ী করেছিলেন। নিজের মারাত্মক ভুলের জন্য মর্মান্তিক জ্বালা এবং কর্ডেলিয়ার শোচনীয় মৃত্যুজনিত আঘাত তাঁকে এতটাই বিচলিত করেছিল যে তিনি সেই আঘাত সহ্য করতে পারেননি। লিয়র বুক ফেটে মারা গেলেন, রেখে গেলেন শোকের আঘাতে বিধ্বস্ত স্নেহশীল পিতৃহৃদয়ের সকরুণ দীর্ঘশ্বাস। এর থেকে বোঝা যায় কর্ডেলিয়ার প্রতি তাঁর ভালোবাসা কতটা তীব্র ছিল।
সীজারকে হত্যা করার পর ব্রুটাস সারাক্ষণ অনুতাপে দগ্ধ হয়েছে, অনুশোচনায় জর্জরিত হয়েছে। আসলে তার মনে সীজারকে হত্যা করার ব্যাপারে প্রচণ্ড সংশয় ও দ্বিধা ছিল। সীজারকে হত্যা করেও সে সেই সংশয়ের হাত থেকে মুক্তি পায়নি, বরং তার হৃদয় দ্বন্দ্বে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। শেষে ব্রুটাস বুঝতে পেরেছিল যে সে বিরাট বড় ভুল করেছে। তাই জীবনের শেষ মুহুর্তে সে স্বীকার করেছিল – “Caesar, now be still; / I killed not thee with half so good a will.” ব্রুটাস ভুল স্বীকার করেছে এবং নিজের জীবনের বিনিময়ে তা পরিশোধ করেছে। ব্রুটাসের মনে সীজারের প্রতি ভালোবাসা ছিল বলেই সে ভুল স্বীকার করেছিল। আসলে ভুল স্বীকার করাটাই মানবিকতা। তাই ব্রুটাস সম্পর্কে অ্যান্টনি বলেছে – “This was a man.” সুতরাং ট্র্যাজিক নায়ক সচেতনভাবে নিজের জীবনের বিনিময়ে স্বকৃত ভুলের সংশোধন করে এবং তা করে নিজের নৈতিক দায়িত্ব ভেবে। তাই ট্র্যাজিক নায়ক হল মনুষ্যত্ব, মানবিকতা ও নৈতিক দায়িত্ববোধের প্রতীক।
সহায়ক গ্রন্থাবলী ও পত্র-পত্রিকা :-
১. The Poetics of Aristotle by S. H. Butcher
২. The Ethics of Aristotle by J. A. K. Thomson
৩. Theory of Drama by Allardyce Nicoll
৪. Natya Sastra, Ed by M. M. Ghosh
৫. সাহিত্য দর্পণ – বিশ্বনাথ কবিরাজ
৬. Ancient History of Sanskrit Literature by Max Muller
৭. History of Sanskrit Literature – A. B. Keith
৮. Greek Society by Anthony Andrews
৯. Evolution of Hindu Ethical Ideas by S. C. Crawford
১০. Tragic Drama of the Greeks by A. E. Haigh
১১. Story of Philosophy by W. Durant
১২. A History of Sanskrit Literature by A. A. Macdonell
১৩. ট্রাজেডি ও করুণ রসতত্ত্বের তুলনামূলক আলোচনা – ডঃ শীতল ঘোষ, ১৯৯৪
১৪. The Idea of Theatre by F. Farguson
১৫. Aesthetics by F. Hegel
১৬. On Literature and Art by Anatoly Lunacharnsky
১৭. Theory of Rasa in Sanskrit Drama by H. R. Mishra