[এই গল্পে হয়তো আধুনিকতার চমক নেই, কিন্তু আধুনিক ভারতকে পথ দেখানোর দিশা আছে। গল্পের প্রয়োজনে মূলানুগ থেকে বিচ্যুত না হয়েও দু‘একটি বাক্য বা শব্দ চয়নের ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।]
আজকের মিছিলটি হয়েছে ভারতের স্বাধীনতা ও পূর্ণ স্বরাজের দাবীতে। হাতে তেরঙা পতাকা নিয়ে বন্দেমাতরম ধ্বনি দিতে দিতে মিছিলটি বাজারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর দুপাশের দর্শকরা মজা দেখার মতো ভীড় করছে। তাদের কাছে এটা নেহাৎ তামাশা ছাড়া কিছু মনে হচ্ছে না।
দীনদয়ালবাবু দোকানের রকে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শম্ভুবাবু তাঁকে উদ্দেশ্য করে বললেন,”ইচ্ছে করে মরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে এরা। ঘোড়সওয়াররা সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। পিটিয়ে সোজা করে দেবে।“
দীনদয়াল সায় দিয়ে বললেন, “মহাত্মা গান্ধীর দিন দিন বুদ্ধিনাশ হচ্ছে। হতদরিদ্র কিছু ছেলে–ছোকরা আর বাউন্ডুলেদের নিয়ে কি আর দেশ স্বাধীন করা যায়, না স্বরাজ মেলে? শহরের একজনও ধনবান ব্যক্তি এদের সাথে নেই।“
মাকু তাদের কাছাকাছি রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। দুই মহাজনের কথা শুনে হেসে ফেটে পড়লো।
শম্ভু চটে গিয়ে বললো, “খুব রঙ ধরেছে না! হাসছো যে বড়ো?”
–“হাসির কথা শুনলে না হেসে কি পারা যায়! ধনবানরা কবে মিছিলে এসে সময় নষ্ট করেছে বলুন তো? এতে তো তাদের লাভ নাই। তাদের বাংলো আছে, গাড়ি আছে, ফূর্তি করার জন্য অঢেল টাকা আছে। সাহেবসুবোদের গা–ঘেঁষতে পারলে তারা ইহজন্ম সার্থক মনে করে। এতো সুখ ছেড়ে তারা কেন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যাবে? মাঝখানে চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছি আমরা। আর ধনবানদের ছেলেরা টেবিল টেনিস খেলছে, গল্ফ খেলছে, চা–কফির টেবিলে আড্ডা মারছে, পার্কের হাওয়ায় গা জুড়িয়ে নিচ্ছে, তারা কোন দুঃখে মিছিলে আসতে যাবে বলুন তো? সুখ আর মস্তি ছেড়ে খামখা পুলিশের লাঠির গুঁতো খেতে কেন তারা আসবে?”
মাকুর কথা শুনে শম্ভুবাবু বললেন, “তোমার বয়স কাঁচা, অভিজ্ঞতা কম। আমরা বলতে চাইছি ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে পাঁচ–ছ‘জন থাকলেও সরকারের উপর চাপ বাড়তো, তাদের টনক নড়তো।“
এসব কথা মাকু অনেক শুনেছে। এর কোন মূল্য নেই তার কাছে । সে বললো, “ধনী ও প্রভাবশালীদের আমরাই তৈরি করি। আবার আমরাই তাদের টেনে নামাই। এমন অনেক লোক আছে যাদের কেউ জানতো না, চিনতো না, আমরাই তাদের সুযোগ দিয়েছি বলেই আজ তারা ধনী ও বিলাসী হতে পেরেছে। তারা অট্টালিকায় বাস করে, দামী গাড়ীতে চড়ে, আর আমাদেরই তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে। আজকের উঠতি বড়োলোকরা তো আমাদের দিকে একবার ফিরেও তাকাবার প্রয়োজন মনে করে না। তাই আমাদের কাছে প্রকৃত বড়লোক তারাই যারা নেংটি পরে, খালি পায়ে চলে, হাতে লাঠি নিয়ে ঘুরে। লাঠি মানে অবলম্বন। আর তাদের লাঠি বা অবলম্বন বলতে তো আমরাই, শক্তি বলতেও আমরাই। কেননা তারা সবসময় আমাদের কথাই ভাবে।“
মাকুর কথায় দীনদয়াল বলে উঠলেন, “থানার নতুন দারোগাটি একদম জল্লাদ। মিছিল দেখলেই ক্ষেপে যায়, হান্টার আর চাবুক হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে।”
মিছিল চৌরাস্তায় পৌঁছানো মাত্রই ঘোড়সওয়ার ও সেপাইদের দল মিছিলটি আটকিয়ে দিলো। দারোগা বীরবল সিংহ বজ্রকন্ঠে বললো, “থামো। এক পাও এগুবে না।
মিছিলের নেতৃত্বে থাকা বয়োবৃদ্ধ ইব্রাহিম আলী বললেন, “দারোগাবাবু কথা দিচ্ছি আমাদের মিছিল হবে সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। কোন হাঙ্গামা হবে না।“
— “ওপর থেকে হুকুম আছে। মিছিল যেন আর না এগোয়।“
— “একবার কথা বলে দেখুন না স্যার।“
— “বলছি তো, হুকুম নেই।“
ইব্রাহিম জলদগম্ভীর কন্ঠে ঘোষণা করলেন, “ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা আসিনি। ইচ্ছে করলে আপনি গুলি চালাতে পারেন, আমরা বুক পেতে দেবো। আমরা সেই দিনের প্রতীক্ষায় থাকবো যেদিন এই দেশের সমস্ত মানুষ এই ধরনের অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসবে। এগিয়ে আসবে তাদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের গোলামীর শৃংখলে যারা নিজেদের বেঁধে রেখেছে।“
দারোগা বীরবল সিংহ খানদানি বংশের মানুষ। তার পিতা এস পি ছিলেন। হাই সোসাইটির মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা ছিলো তাঁর। কিন্তু সকলের প্রতি সমদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। আইনের রক্ষক হলেও হৃদয়হীন ছিলেন না।
তাই ইব্রাহিমের কথায় সে কিছুক্ষণের জন্য দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো। কিন্তু ডি এস পি সাহেবকে এগিয়ে আসতে দেখেই তার তৎপরতা বেড়ে গেলো। সাহেবের সামনে নিজের কর্মদক্ষতা দেখানোর এই সুযোগ সে ছাড়তে চায় না। সে ব্যাটন হাতে ঘোড়ার লাগাম টেনে মিছিলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ইব্রাহিম তার সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাজেই তাঁর উপর ঘোড়া ছোটানো মাত্রই তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। মিছিলের লোকেরা স্বাধীনতার সৈনিক, দেশ–মাতৃকার চরণতলে আত্মনিবেদিত। ইব্রাহিমের হুকুম পেলে তারা ঘোড়সওয়ারদের আবেষ্টনী ছিন্ন করতে পারতো। কিন্তু আদর্শবাদ ও সেবার ধর্মে দীক্ষিত তারা মুখ বুজে পুলিশের অত্যাচার নীরবে সহ্য করলো। দশ বারো মিনিট তাণ্ডব চালিয়ে পুলিশ যখন থামলো, তখন স্বেচ্ছাসেবকরা অনেকেই আহত।
পুলিশের হাতে স্বেচ্ছাসেবকদের আহত হওয়ার খবর দ্রুত দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়লো। স্বয়ং ইব্রাহিম সাহেব ঘোড়ার পায়ের চাপে গুরুতরভাবে আহত হয়ে প্রায় সংজ্ঞা হারিয়েছেন।
মাকু ক্ষেপে গিয়ে বললো, “আর চুপ করে থাকা যায় না। আমি চললাম স্বেচ্ছাসেবকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।“
শম্ভুবাবু দোকানের ঝাঁপ বন্ধ করে বললেন, “চলো আমিও যাবো।” কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত দোকান বন্ধ হয়ে গেলো। হাজার হাজার মানুষ পথে নামলো, তাদের কারো হাতে লাঠি, কারো পকেটে পাথরের টুকরো। দারোগা বীরবল সিংহ অবস্থা বুঝে পিছু হটলো।
ইব্রাহিম সাহেব অচেতনভাবে মাটিতে পড়েছিলেন। মানুষের হৈ চৈ –এ তিনি চোখ খুলে সামনে কৈলাসকে দেখে মৃদু স্বরে বললেন, “কতো লোক মিছিলে যোগ দিতে এসেছে?”
— তা প্রায় কয়েক হাজার হবে।
— তাহলে তো ঝামেলা হয়ে যাবে। পতাকা নামিয়ে নাও। কোনো লড়াই নয়, সকলে ফিরে চলো।
ইব্রাহিম ওঠার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না। মিছিলের বাঁশ, পাগড়ি ও রুমাল দিয়ে অস্থায়ীভাবে একটি স্ট্রেচার তৈরি করা হলো। সেই স্ট্রেচারে ইব্রাহিম সাহেবকে শুইয়ে নিয়ে তারা তাঁর বাড়ির দিকে চললো।
দুই
তিনদিন পর। বীরবল সিংহ তখন চা খাচ্ছে। তার স্ত্রী মিটঠনবাই কোলে বাচ্চা নিয়ে তার সামনে এসে বললো, “স্বেচ্ছাসেবকদের উপর তোমার নির্মম আচরণকে কোনভাবেই সমর্থন করা যায় না।“
বীরবল আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মিনমিন করে বললো, “আমার তখন কিছুই করার ছিলো না। ডি এস পি সাহেব চলে এসেছিলেন। ওদের যেতে দিলে আমাদের জীবন সংশয় হতে পারতো।“
মিটঠনবাই বললো, “কিন্তু তোমার চেষ্টা করা উচিৎ ছিলো যাতে স্বেচ্ছাসেবকদের মাথায় লাঠি না পড়ে এবং ওঁদের নেতা ঐরকমভাবে আহত না হন। ওদের দলে এমন লোকও আছেন যাঁরা তোমাদের মতো লোককে চাকর রাখতে পারেন। অনেক শিক্ষিত, দেশব্রতী লোক আছেন যাঁরা দেশকে ভালোবাসেন। আর তোমরা কিনা ওঁদের লাঠিপেটা করলে, ইব্রাহিম সাহেবের মতো লোকের উপর ঘোড়া ছুটিয়ে দিলে! ধিক তোমাদের।“
বীরবল স্ত্রীকে সন্তুষ্ট করার জন্য বললো, “জানো, সেদিন আমার কর্তব্যপরায়ণতা দেখে ডি এস পি সাহেব আমার নাম গুড বুকে নথিভুক্ত করেছেন।“
মিটঠনবাই আরো কঠিন কন্ঠে বললো, “হ্যাঁ, চাকরিতে তোমার প্রমোশন হবে। নিরীহ মানুষদের ওপর লাঠি চালানোর জন্য প্রমোশন হবে। কিন্তু ইতিহাস যে তোমাকে যে দেশদ্রোহীদের তালিকাভুক্ত করে রাখবে সে কথা কি ভেবেছো?” একটুখানি চুপ করে থেকে সে আবার বললো, “গর্বে আমার বুক ফুলে ওঠবে, যখন শুনবো অমার স্বামী কোনো প্রকৃত খুনীকে খুঁজে বের করেছে, কোন ডুবন্ত মানুষকে উদ্ধার করেছে, আগুনে পুড়তে যাওয়া কোনো মানুষকে রক্ষা করতে পেরেছে।“
ঠিক তখনই একজন সেপাই এসে তাকে সেলাম ঠুকে বললো, “হুজুর, এই যে আপনার একটা জরুরী চিঠি নিয়ে এসেছি।” বীরবল চিঠির ওপর একবার চোখ বুলিয়ে সেটা টেবিলে রাখলো। মিটঠনবাই ব্যঙ্গ করে বললো, “নিশ্চয়ই প্রমোশনের চিঠি।“
বীরবল বিষণ্ণ কন্ঠে শুধু বললো, “আমাকে আর কতো বিদ্রূপ করবে? আজ আবার মিছিল বেরুবে। আমাকে ওই মিছিল আটকাবার জন্য ওপর থেকে হুকুম হয়েছে।“
মিটঠনবাই কৃত্রিম উল্লাস দেখিয়ে বললো, “ব্রেভো! গ্রেট অপারচুনিটি। গেট রেডি টু জয়েন। অবশ্য দেশসেবকদের দলে নয়, দেশের দুশমনদের দলে।“
বীরবল স্ত্রীকে অসহায়ভাবে বোঝাতে চাইলো, “তুমি শুধু এক তরফা বলে চলেছো, একবারও আমার অবস্থাটা চিন্তা করছো না। আমি যদি জনতার মিছিলে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি তাহলে সেটা হবে আমার কর্তব্যের প্রতি অবহেলা। আর যদি মিছিলকারীদের প্রতি কোনোরকম সহানুভূতি দেখাই সেটা হবে আমার চাকরী জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুল। আমাকে বরখাস্ত না করলেও লাইনে স্ট্যান্ড বাই করে রেখে দেবে মাছি তাড়ানোর জন্য।
একটু পরেই বাজনার শব্দ ভেসে এলো। সেপাইটি এসে আবার সেলাম ঠুকে বললো, “হুজুর আন্দোলনকারীদের বাজনা বাজছে। আজ বিশাল মিছিল হবে।” বীরবল স্ত্রীর দিকে না তাকিয়ে ড্রেস পরে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। অপেক্ষারত সেপাইদের নিয়ে মার্চ করতে করতে সে এগিয়ে চললো।
বীরবল তার পুলিশ বাহিনী নিয়ে মিছিলকারীদের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তাকে দেখামাত্রই মিছিলকারীরা দিগন্ত কাঁপিয়ে ধ্বনি তুললো, “বন্দেমাতরম!” পুলিশের বিরুদ্ধে তাদের বুকে জমে থাকা সব ঘৃণা যেন বাঁধ ভাঙ্গা ঢেউয়ের মতো আছড়িয়ে পড়লো।
তিনদিন আগেকার মিছিল, আর আজকের মিছিলের মধ্যে যেন আকাশ–পাতাল তফাৎ! সেদিন ছিলো দেশের জন্য স্বাধীনতার দাবীর মিছিল। আজকের মিছিল হলো শহীদের শোক মিছিল, যাকে মিছিল না বলে শোভাযাত্রা বলাই শোভন। মিছিলে দাবী–দাওয়া থাকে, আজকের শোভাযাত্রায় আছে শুধু হৃদয় নিংড়ানো শ্রদ্ধা।
জননেতা ইব্রাহিম আলী তিন দিন ধরে প্রচণ্ড জ্বর আর যন্ত্রণা নিয়ে শয্যাগত ছিলেন। আজ সকালে তাঁর জীবনাবসান হয়েছে। তিনি ছিলেন এমন একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী জনদরদী নেতা, যিনি কখনও ক্ষমতাধারীদের কাছে মাথা নত করেননি, শত প্রলোভন দিয়েও রাজশক্তি বারবার তাকে কুর্নিশ জানিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মহাত্মা গান্ধীর অনুরক্ত ভক্ত হিসেবে তিনি ছিলেন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গকৃত প্রাণ। মৃত্যুর সময় সন্নিকট জেনে তিনি তাঁর স্ত্রীকে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী সাথীদের ডেকে বলে গিয়েছেন তাঁর মৃতদেহ যেন গঙ্গার পানি এনে গোসল১ দিয়ে জানাজার২ জন্য তাঁবুতে৩ তোলা হয়। আর তাঁকে কবর দেওয়ার পর কবরের পাশে যেন স্বাধীনতার তেরঙ্গা পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়।
ইব্রাহিম সাহেবের মৃত্যুর কথা ছড়িয়ে পড়ামাত্রই গোটা শহরে শোকের ছায়া নেমে এলো। স্তব্ধ হয়ে গেলো শহরের জনজীবন। মানুষজন দলে দলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলো। শোক–শোভাযাত্রা ক্রমেই বেড়ে চললো। দূর–দূরান্ত থেকেও মানুষরা, হিন্দু–মুসলমান নির্বিশেষে আসতে লাগলো। সকলেই ভারতমাতার স্বাধীনতার সন্তানকে হারিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো।
দেশপ্রেমিক বীরের শেষ–কৃত্যের এই শোভাযাত্রায় আজ শুধু মানুষ আর মানুষ। প্রথম সারিতেই বহু মহিলা ছিলেন। তাঁদের অগ্রভাগেই মিটঠন বাইকে দেখা গেলো। বীরবল ঘোড়সওয়ার ও সিপাহীদের মিছিলের সঙ্গে থাকতে বলে নিজে একদম পেছনে চলে গেলো। সে বিশ্বাস করতেই পারেনি যে, তার স্ত্রী তার বিরুদ্ধে গিয়ে এই শোক মিছিলে যোগ দেবে। তার স্ত্রীর দিকে চোখ পড়তেই সে তার চোখে একরাশ ঘৃণা দেখে কেঁপে উঠলো। তাকে বিষণ্ণ ও শান্তভাবে পেছনে দেখে এক তরুণ বললো, “দারোগা সাহেব, আজ অন্ততঃ আমাদের উপর গুলি চালাবেন না। তাতে এক মহান মানুষের আত্মা কষ্ট পাবে।” একটি তরুণী ইঙ্গিতপূর্ণভাবে মন্তব্য করলো, “বোধহয় এই হীন কাজটি যে করেছে সে ঠিক আপনার মতোই দেখতে অন্য কেউ। নিশ্চয়ই আপনি নন।“ মিছিলের মধ্যে থেকে কেউ যেনো বলে উঠলো, “না, না। অন্য কেউ নয়। এই কু–কাজটি উনিই করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজ উঠলো, “নমস্কার জানাই আপনাকে। আপনার জন্যই আজ দলে দলে আমরা হাজির হয়েছি আপনার লাঠি খাওয়ার জন্য। আমাদের মহান নেতা যখন শহীদ হয়েছেন, তখন আমাদের শহীদ হতে কোনো আপত্তি নাই।“
একজন বললো, “আপনি তো আমাদের দেশের নন। আপনাকে দেখতে ঠিক ইংরেজ বলেই মনে হচ্ছে।“
একজন বৃদ্ধা মহিলা চিৎকার করে বললেন, “আমার পেটে যদি এমন কুলাঙ্গার জন্মাতো, জন্মের সঙ্গে সঙ্গে তার মুখে লবণ দিয়ে গলা টিপে মেরে দিতাম।“
একজন যুবতীকে বলতে শোনা গেলো, “কি যে বলেন মাসীমা, কুকুরও নুন খেলে গুণ গায়, উনিও ব্রিটিশের নুন খেয়েছেন, তাদেরই গুণ গাইবেন।“
বৃদ্ধা যেন ক্ষেপে গেলেন। আরও চেঁচিয়ে বললেন, “ও বলবে পেটের দায়। হায় রে পেট! হায় রে পেট! অমন পেটে লাথি মারি।“
বীরবল আর সহ্য করতে পারলো না। ঘোড়াকে চাবুক মেরে নিমেষে তাদের কাছ থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলো। মহিলাদের বাক্যবাণ কতো তীব্র ও তীক্ষ্ণ হতে পারে তা এই প্রথম সে উপলব্ধি করলো। কোন মহিলার সামনে দাঁড়াতে তার আর সাহস হলো না। তার সব রাগ গিয়ে পড়লো তার উর্ধ্বতন অফিসারদের ওপর, যারা বারবার এইসব অপ্রিয় কাজ তার ওপর চাপিয়ে দেয়। কেন সে ছাড়া কি ব্রিটিশের পুলিশ বাহিনীতে অন্য অফিসার নেই? সে ক্ষুব্ধ হয়ে নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে।
তার সবচেয়ে কষ্ট হলো এটা ভেবে যে, যার জন্য সে উদয়াস্ত খেটে চলেছে সেই মিটঠনই তাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছে। এখন যদি জনতার রোষ তার ওপর পড়ে এবং সে গণপিটুনিতে মারা যায়, মিটঠন হয়তো একটুও চোখের জল ফেলবে না। সে দেশদ্রোহী স্বামীর সব স্মৃতি তার সন্তানের মন থেকেও মুছে দেবে।
শহরের প্রধান সড়ক দিয়ে সেই শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে। জনতার চাপ এতো বাড়ছে যে, তারা যদি একবার মারমুখী হয়ে ওঠে একজন পুলিশ কর্মীরও রেহাই মিলবে না। সে দেখলো, ভীড়ে যারা আসতে পারছে না, তারা বাড়ির কার্নিশে, গাছের ডালে, বাগানে—যে যেখানে পারছে শোভাযাত্রার সঙ্গে সহমর্মিতার আন্তরিক তাগিদে ছুটে আসছে।
সহসা তার মনে হলো, যাঁকে দেখার জন্য লক্ষ মানুষের জনজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে, যাঁর পদধূলি নেওয়ার জন্য লোকদের মধ্যে কাড়াকাড়ি পড়ে গিয়েছে- সে সেই মহান মানুষটির প্রতি সে অশালীন ব্যবহার করেছে, নির্দয়ভাবে অত্যাচার করেছে! সে আর ভাবতে পারলো না। লজ্জা, দুঃখ, যন্ত্রণায় সে কুঁকড়ে গেলো।
ইব্রাহিমের মরদেহ নিয়ে শোভাযাত্রাটি এবার মোড় নিলো তাঁদের পারিবারিক কবরস্থানের দিকে।
মহান নেতার সমাধির কাজ সম্পন্ন হতে হতে প্রায় আড়াইটা বেজে গেলো। মিটঠনবাই সব মহিলাদের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে কোলের শিশুকে বুকে জড়িয়ে তখনো এগিয়ে চলেছে। কুইন্স পার্কের কাছে এসে সে থমকে দাঁড়ালো। তার মনে হলো বাড়ি ফেরার সব রাস্তা তার জন্য বন্ধ। স্বামী নামে যে লোকটা এই মহান মানুষকে হত্যা করেছে সে কিছুতেই আর তার সঙ্গে ঘর করতে পারবে না। তবে কি সে বাপের বাড়ি ফিরে যাবে? না, তা আর সম্ভব নয়, গলগ্রহ হবে না সে কারও। তারচেয়ে যতোটুকু জোটে, ততোটুকুই উপার্জন করে সে জীবিকা নির্বাহ করবে। হঠাৎ ইব্রাহিম আলীর বৃদ্ধা পত্নীর কথা তার মানে উদয় হলো। তিনি তো একা, সদ্য স্বামীহারা, নিঃসঙ্গ এক মহিলা। তাঁকে সান্ত্বনা জানানোর জন্য কেউ নেই। সে মিছিলের কিছু মহিলার কাছে তাঁর বাড়ির ঠিকানা টুকে নিয়েছিল আগেই। সে মুহূর্ত দেরী না করে ইব্রাহিম সাহেবের বিধবা স্ত্রীর বাড়ির দিকে পা বাড়ালো। কিন্তু কি করবে সে সেখানে, কিভাবেই বা সান্ত্বনা দেবে সে সদ্য স্বামীহারা মাতৃসমা এক মহিলাকে! ভাবতে ভাবতে সে একসময় দেখলো ইব্রাহিম সাহেবের বাড়ি পৌঁছে গিয়েছে।
কয়েকটি গলি পার হয়ে সেই বাড়ি। গোটা বাড়িটা যেন শোকের প্রতিমূর্তি! সে ঢুকতেই শোকের লু‘ হাওয়া চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লো। মিটঠন দেখলো একজন শোকার্ত মহিলা একটি জরাজীর্ণ খাটের ওপর বসে আছেন। আর তাঁর সামনে সর্বাঙ্গ সাদা পোশাকে নিজেকে আবৃত করে এক যুবা পুরুষ হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখ দিয়ে বিগলিত ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।
মিটঠন চমকে উঠলো! কারণ ঐ যুবক অন্য কেউ নয়, তার স্বামী বীরবল।
বীরবল বললো, “আমি এসেছি মাতৃসমা এই মহিলার সন্তান হয়ে ক্ষমা চাইতে, পিতৃহত্যার মতো মহাপাপ থেকে মুক্ত হতে। অধম সন্তানের মতো চিরকাল তাঁর সেবা করবার অনুমতি নিতে। আমার সৌভাগ্য মা আমাকে ক্ষমা করেছেন।“
মিটঠন গলবস্ত্র হয়ে তাঁর পায়ের নীচে বসে কাঁদতে কাঁদতে বললো, “মা, আমাকে ক্ষমা করুন। আমি আপনার ঐ অধম সন্তান বীরবলের সহধর্মিণী।“
মহান নেতা ইব্রাহিমের স্ত্রী, যেন যোগিনীর মতো ধীর, স্থির; তাপসীর মতো উজ্জ্বল এক মাতৃমূর্তি! তাঁর দুটো শীর্ণ হাত বাড়িয়ে বললেন, “ওরে তোদের স্থান পায়ে নয়, আমার বুকে। তোরা হয়তো কোন এক জন্মে আমার গর্ভের সন্তানই ছিলি। মা কি তার সন্তানদের ক্ষমা না করে পারে!
____________________________________
১.মুসলমান প্রথানুযায়ী মৃতদেহকে কবরে শায়িত করার জন্য নিয়ে যাওয়ার আগে তাকে শরিয়তী শর্ত–অনুযায়ী পবিত্র করার জন্য স্নান ও অজু করানো হয়। একে গোসল বা তলগোসল বলে। জমজমের পানি যেমন মুসলমানদের কাছে পবিত্র, তেমনি ভারতে গঙ্গার পানিকেও পবিত্র মনে করা হয়ে থাকে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ইব্রাহিম সাহেব তাই গঙ্গাজল দিয়ে তাঁর মৃতদেহ পবিত্রকরণের কাজ সমাধা করার কথা সিদ্ধান্ত নেন।
২. মৃত ব্যক্তির পারলৌকিক কল্যাণ কামনায় বিশেষ ধরনের প্রার্থনা।
৩. মৃতদেহ বহনের খাট।
মুন্সী প্রেমচন্দ: ‘উপন্যাস সম্রাট‘ মুন্সী প্রেমচন্দের জন্ম ৩১ জুলাই, ১৮৮০ উত্তরপ্রদেশের বারাণসীর ‘লামহি‘ নামে একটি গ্রামে বিশিষ্ট কায়স্থ বংশে। তাঁর পিতার নাম অজাইবলাল এবং মাতার নাম আনন্দি দেবী। পৈতৃক নাম ধনপতি রাই শ্রীবাস্তব হলেও তাঁর সাহিত্য নাম নবাব রাই এবং মুন্সী প্রেমচন্দ নামেই তিনি অধিক পরিচিত। তাঁর কাকা আদর করে তাঁর ডাকনাম রাখেন নবাব। পরে তিনি নবাব রাই নামে লেখালেখি শুরু করেন। প্রেমচন্দ মুন্সী ছদ্মনামটি তিনি সম্ভবতঃ কানপুরে থাকার সময় (১৯০৫—১৯০৯) উর্দু জমানা পত্রিকার সম্পাদক মুন্সী দয়ানারায়ণ নিগমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সূত্রে তাঁর পরামর্শ–অনুযায়ী গ্রহণ করেন। তিনি ১৪ টি উপন্যাস ও ৩০০ টি ছোট গল্প লিখেছেন। এছাড়া অনেক নাটক ও প্রবন্ধও লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস গুলোর মধ্যে গোদান, বাজার–ই–হুসন, কর্মভূমি, শতরঞ্জ–কি–খিলাড়ি, ঈদগাহ প্রভৃতির নাম উল্লেখযোগ্য। তাঁর প্রথম বিবাহ সুখের হয়নি। ১৯০৬ সালে শিবারানী নামে এক বালবিধবা মেয়েকে বিবাহ করে তিনি তৎকালীন সমাজে আলোড়ন তোলেন। ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসের ৮ তারিখে মাত্র ৫৬ বছর বয়সে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শিবারানী একটি উপন্যাস লেখেন, ‘প্রেমচন্দ ঘর মে‘। মৃত্যুর পর স্ত্রীর কাছে তিনি যেমন অমর ছিলেন, তেমনি তাঁর অনুরাগী লক্ষ লক্ষ পাঠকের কাছে তিনি আজও অমর হয়ে আছেন।