Home / ছোটদের গল্প / পুজোর জামা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

পুজোর জামা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

শিল্পী- পুণ্যতোয়া/ পুজোর জামা
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে সামনের মোড়টা ঘুরলেই ডান হাতে পড়ে একটা আট বাই বারো ফুটের ছোট্ট দর্জির দোকান, ‘নদীয়া টেলারিং শপ’। বছরের এই একটা সময় দর্জি চাচার দোকানে লোকের ভিড়ে একটা মাছি ওড়ারও জায়গা পায় না। রথতলার মাঠে বাঁশ পড়ার ঢের আগে, স্কুলের হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষা শুরু হবার অনেক আগে এমনকি ড্রইং খাতার ছবি মেলানো নীল সাদা আকাশ খড়খড়ির ফাঁক গলে উঁকি দেবার আগেই দর্জি চাচার দোকানের ভিড় জানান দেয়, পুজো আসছে। তারপর একদিন অফিস ফেরত বাবা যখন ব্যাগ খুলে লাল নীল ছোট ছোট প্যাকেট বের করে আনলো, তখন আর আমাদের পায় কে!

বাবা সেগুলো আমাদের হাতে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ” কিরে, পছন্দ তো? ” আমরা ফুল ফুল ছাপা সাটিনের কাপড়গুলো গায়ে মেলে ধরে লম্বা করে ঘাড় হেলালাম। আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মায়ের মুখেও আলগা হাসি লেগে আছে। ঠিক যেন দুর্গা মায়ের মুখ। মা সেগুলো গুছোতে গুছোতে বললো, “যাও, এবার গিয়ে পড়তে বসো। সামনে পরীক্ষা।” তারপর বাবাকে ডেকে বলল, “শনিবার দিন বিকেল করে ওদের নিয়ে জামার মাপগুলো দিয়ে এসো। আর বোলো, এবার যেন একটু লম্বা করে বানায়। সামনে শীত আসছে। পরতে পারবে।”

আমরা দর্জি চাচার দোকানে তিন ভাইবোনে বাবার হাত ধরে গেলাম। দর্জি চাচা আমাদের পরপর লাইনে দাঁড় করিয়ে মাপ নিল। তারপর মন দিয়ে খাতায় কিসব আঁক কষতে লাগলো। বাবা বললো, “কিগো, কাপড় ভালো তো?” চাচা মাথা নাড়িয়ে কানে পেন্সিল গুঁজে সায় দিলো। বাবা বললো ফের, “এবারে কিন্তু ঝুল একটু বড় রেখ। এখন তো শরীর বাড়তির দিকে। না হলে দুদিন বাদেই আর পরতে পারবে না। খাটো হয়ে যাবে।” চাচা কাঁচি চালাতে চালাতে বললো, “আইচ্ছা কত্তা। যতটা কাপড় আছে সবটাই কাজে লাগাইয়া দিমু।” তারপর একটা বাঁধাই করা খাতা আমাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, “দেখ দেখি খুকি, কোন ছবিটা পছন্দ।” আমরা  পাতা উল্টিয়েই গেলাম। ঠিক করে উঠতে পারলাম না। সব ছবিই মনে হল, কী সুন্দর! এমন ধারা হলে কতই না মানাবে আমাদের। দেরি হচ্ছে দেখে বাবা খাতাটা নিয়ে চাচার দিকে তাকিয়ে বললো, “ও, ওরা বুঝবে না অত। তুমি যেটা ভালো মানাবে ওটাই বানিয়ে দিও। তবে দেখো পঞ্চমীর আগে যেন হয়ে যায়।” চাচা , “আজ্ঞে কত্তা” বলে রসিদ ধরিয়ে দিল বাবার হাতে। আমাদের সেই থেকে শুরু হল দিন গোনার পালা।

তারপর একদিন এমনি করেই ঢিমে তালে এগোতে এগোতে ঝুপ করে এসে পড়লো পুজোটা। হইহই করে স্কুলে পড়ে গেলো পুজোর ছুটি। আমরাও বই খাতা দেরাজে তুলে দিয়ে পাড়ার ফাংশনে পার্ট নেবার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। মহালয়ার ভোরে তর্পণ সেরে ফেরার পথে কুমোরটুলি থেকে ঠাকুর বায়না করে এলো বাবা, জেঠুরা। মা মনে করিয়ে দিলো, “আজ বিকেলে কিন্তু দর্জি চাচার দোকানে একটু খোঁজ নিও। তারিখ তো হয়েই গেছে।” কথাটা কানে যেতেই মনের মধ্যে যেন মুঠো মুঠো প্রজাপতি ওড়াউড়ি করতে লাগলো। বাবা সন্ধেবেলায় জামা নিয়ে আসতেই পরে ফেললাম আমরা ভাইবোনেরা। কি সুন্দর সেই জামা, তার কী চওড়া ঘের, কী সুন্দর কুঁচিআয়না, শীত, ছুটি দেওয়া হাতা। নিজেদের আয়নায় দেখে মন ভরে গেলো। শুধু মা প্রতিবারের মতই যেন একটু রাগ করে বললো, “দেখলে তো মিহির চাচার কান্ডটা। এবার বেশি করে কাপড় আনা হল, তাও দেখ হাঁটু ছুঁলো না ঠিকভাবে। আর হাতগুলো দেখো, কেমন ঘটি হাতা । এ জামা দিয়ে কি শীত ঢাকবে? ” বাবা খোশমেজাজে বললো, ” দেখতে কিন্তু বেশ। সোনা, রুপু, গণশাকে কেমন মানিয়েছে দেখো।” আমাদের খুশি দেখে মা আর কিছু বললো না।

সপ্তমীর দিন জেঠুর সাথে ঠাকুর দেখে ফেরার পথে দেখলাম, দর্জি চাচার দোকান থেকে নতুন জামা পরে বেরিয়ে আসছে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলো। খুশিতে ঝলমল তাদের চোখ মুখ। ঐ যারা আমাদের বাড়ির সামনের ফুটপাথে থাকে। ওদের প্রতি বছরই চাচা পুজোর সময় নতুন জামা দেয়। তারপর দোকান বন্ধ করে একমাসের জন্য দেশের বাড়ি চলে যায়। আমি , রূপু , ভাই লক্ষ্য করে দেখলাম দু-এক জনের জামার হাতা কিংবা কোমরের কাছ থেকে ঝুলটা কিংবা ওই প্যান্টটা কেমন যেন হুবহু আমাদের জামার মতই। একই রং, একই ছাপা। জেঠুকেও দেখালাম। আমাদের মত জেঠুরও খুব আনন্দ হল দেখে। বলল, “ভাগ্যিস চাচা ছিল। তাই তো ওরা এই বছরও নতুন জামার গন্ধ পেল।”

………০………

Leave a comment

Check Also

দু’একটা সত্য কথা – সুদীপ্ত বিশ্বাস

মাত্র ১০০০০ বছর আগে কোনো ধর্মই ছিল না। ছিলনা ধর্ম-ধর্ম করে মানুষের সাথে মানুষের বিভেদ। …

শিল্পী- যামিনী খাঁ

আজ অভিষেক – নির্মাল্য ঘরামী

    -মনে আছে তো, পুলিন বলছিল, -তরশু তোর আবার হাতে রাজকাজ। বলছিল আর মিটমিট …

১৯৭৫ থেকে ১৯৮১: মুজিব হত্যা ও সামরিক শাসনে বাংলাদেশ – নির্মাল্য ঘরামী

বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা পায়। সেই সময়ের ঘটনাবলী আমরা সবাই কমবেশী জানি। বিশেষ করে ১৯৭১ …

দীপালিকায় জ্বালাও আলো- মৌসুমী পাত্র

অন্ধকার কি দূর হয় এতোই সহজে? এতোই সহজ? দীপাবলি আলোর উৎসব। এবং শব্দের। এবং অপরিণামদর্শিতার। …