Home / গল্প / না ভূতের গল্প – নবকুমার দাস

না ভূতের গল্প – নবকুমার দাস

শিল্পী- পুণ্যতোয়া/ না ভূতের গল্প
শিল্পী- পুণ্যতোয়া

 

এই গল্পটি শুনেছিলাম বড় দাদুর কাছে।

আমার দুই দাদু মানে মায়ের বাবা ও কাকা বা আমাদের দাদামশাইরা ছিলেন অলিখিত ভূতের গল্পের অফুরান ভান্ডার। বড়দাদু মানে আমার মাতামহ প্রয়াত কিঙ্কর চন্দ্র দাস, প্রকৃত অর্থে ছিলেন আমার গল্পদাদু। কয়েক হাজার লোকায়ত গল্পের আদত খনি ছিলেন তিনি। ভূত-প্রেত, দত্যি-দানো, পেঁচোয় পাওয়া, বোবায় ধরা, নিশির ডাক, ভুলোয় ভুলানো ইত্যাদির পাশাপাশি শাঁকচুন্নি, মামদো, ব্রহ্মদত্যি, স্কন্ধকাটা ইত্যাদি নানান দিশি -বিদেশী ভুতের গল্পে আসর জমিয়ে দিতেন কিন্তু কোন গল্পই তিনি লিখে রেখে যাননি। আসলে আমাদের ছোটবেলায় গ্রামাঞ্চলে মুখে মুখে লোক পরম্পরায় গল্প বলার চল ছিল। তিনি গল্প বলতে ভালোবাসতেন কিন্তু লিখতেন না। কিন্তু এই সব কাহিনী নানান সামাজিক মেলামেশায়, চন্ডীমন্ডপের গাল-গল্প আর ইয়ার-দোস্তদের আড্ডায় সীমাবদ্ধ থাকতো না; ক্রমে ক্রমে জনশ্রুতিতে পরিণত হত । হালফিলের মোবাইল ফোন দূর অস্ত, তখনো পর্যন্ত টেলিভিশন সর্বত্রগামী হয়নি । বাংলার গ্রামেগঞ্জে দুই একটা ট্রানজিস্টার রেডিও সবে সবে ঢুকেছে মাত্র। সেই সব দিনে তাই মুখোমুখি বসে এই সব গল্প শোনা এবং শোনানো এক অন্যরকম অনুভূতি ছিল ।

শুনেছি দাদুর এক জ্ঞাতিভাই দ্বিজপদ ছিলেন কবিয়াল। স্থানীয় মানুষজন বলত ছড়াদার। মা এখনো বলেন ছড়াদার জ্যাঠা। শুনেছি মুখে মুখে ছড়া কাটতেন তিনি। রামায়ণ, মহাভারত, বেদ-পুরাণের গল্প কাহিনীকে ছন্দের মোড়কে এনে ফেলতেন কবিগানে। রাঢ়বঙ্গে নবান্ন কিংবা পুজো-অর্চনা উপলক্ষ্যে কবিয়ালদাদু সেইসব গানের ঝাঁপি খুলে বসতেন। অজয়- ময়ূরাক্ষী, মেঘনা-পদ্মা, গঙ্গা-যমুনায় তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। কবিগানের আসর অনেককাল আগে গুটিয়ে গেলেও গ্রামীণ জীবনের কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির চন্ডীমন্ডপ কিংবা রাধামাধবের আটচালায় আড্ডা তখনো কমেনি। বর্ষা বাদল কিংবা শীতের রাত্রে গল্পের ভিয়েন বসত যেন। ঘোর বর্ষায় কিংবা হাড় কাঁপানো শীতে আমরা তুতো ভাইবোনেরা বড়দাদু কিংবা ছোটদাদুর মধ্যে কোন একজনকে ঘিরে ধরে গোল হয়ে বসে সেই সব উত্তেজনাময় ও রোমহর্ষক গল্প শুনতাম। এই সব গল্পের আসরে বড়দাদু ছিলেন অনবদ্য গল্প বলিয়ে। প্রায় বছর ষোল আগে তাঁর দেহান্ত হয়েছে। গল্পবলিয়ে সেই দাদু হারিয়ে গেলেও তার বলা গল্পগুলির কথা মনে পড়লে আজো মনে হয় দাদু আছেন অন্য কোথাও। কিছুদিনের জন্যে তিনি হয়তো কোথাও বেড়াতে গেছেন। বড়দাদু ছিলেন আমাদের ভীষণ প্রিয় ও গল্পবলিয়ে এক মজাদার মানুষ। তাঁর জীবন ছিল বিচিত্র ধরনের। অনেক রকমের ব্যবসাপত্র করে দেখেছেন, চাকরি-বাকরির চেষ্টাও করেছেন। তবে শেষবয়সে শুধুমাত্র চাষবাস-জমিজমার দেখাশুনো ও রাধামাধবের নাম নিয়ে থেকেছেন তিনি। অনেকদিন যাওয়া হয়না কিন্তু দাদু থুড়ি মামাবাড়ির মাঠভর্তি ফসল,গোলাভর্তি ধান এবং পুকুরভর্তি মাছের উজ্জ্বল ছবি মাঝে মাঝে আমার বেশ মনে পড়ে। অগ্রহায়ণ মাসের নবান্ন উৎসব কিংবা চৈত্র সংক্রান্তির গাজনের সময়ে মামার বাড়ি যাওয়ার আলাদা রকমের অনুভূতি ছিল।


সে যাই হোক বড়দাদুর চেনাজানা ও অভিজ্ঞতার দুনিয়াটা বেয়াড়া রকমের আলাদা ছিল । প্রথমদিকে চকমকি পাথর ও শোলা এবং শেষের দিকে পেট্রলের লাইটার দিয়ে নিজের তৈরী কিংসাইজ বিড়ি কিংবা ক্যাপস্টান সিগারেট ধরিয়ে ছোটছোট সুখটান দিয়ে গল্পবলা শুরু করতেন। আমরা চুপ করে একমনে তাঁকে দেখতাম আর গল্পের জন্যে অপেক্ষা করতাম। লম্বা গোঁফওয়ালা ও দীর্ঘ চেহারা ও উজ্জ্বল চোখের দাদুর কাছে গ্রামগঞ্জ ও নানান তল্লাটের অদ্ভুত গল্প শুনতে বেশ লাগত। তবে শর্ত ছিল একটাই, একবারে একটি মাত্র গল্প। এক আসরে বড়দাদু দুটো গল্প বলতেন না। অবশ্য আমরা দৈনিক একখানি করে গল্প শুনেই মাত হয়ে যেতাম।
না ভূতের এই গল্পটা আমার মামার বাড়ির। অবশ্য শুনেছি ঘটনাটি ঘটার সময়ে মা কিংবা মামাদের জন্মই হয়নি। সত্তর-পঁচাত্তর বছর আগের কথা। কলকাতা শহর থেকে প্রায় দুশো কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মুর্শিদাবাদ জেলার একটি গ্রামের কাহিনী। গ্রামটির নাম কুঁদুলে। বিশাল এক মাঠের মাঝে খুব ছোট্ট একটা গ্রাম। সাকুল্যে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশটি পরিবারের বাস। কুঁদুলের উত্তরে গুনুটিয়া, উত্তর-পশ্চিমের গ্রাম ধুঁধুলে। পশ্চিমে আইজুনি, দক্ষিণ-পশ্চিমে দিকে মসড্ডা ও খাঁড়েরা গ্রাম, দক্ষিণ পূর্বদিকে সেনপাড়া ,আউচা, পূর্বদিকে মাখালতোর এবং উত্তর পূর্বদিকে গলপাড়া গ্রাম । দক্ষিণ-পশ্চিমে মসড্ডা ও খাঁড়েরার দিক থেকে উত্তর পূর্বদিকের গলপাড়া গ্রামের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে ময়ূরাক্ষীর ব্রাঞ্চখাল। সবাই এই খালটাকে ক্যানেল বলে, কেউ কেউ বলে ক্যালেন । এই ক্যানেলের ধার ঘেঁষে গরু-মোষের গাড়ি চলাচলের রাস্তাটিই এই কুঁদুলে গ্রামের সঙ্গে বাইরের গ্রাম বা দুনিয়ার সংযোগের অন্যতম পথ। সেই পথের পাশেই মামাদের পুকুর গুনোগোড়ে । এই জলাশয় খুব একটা বড় নয়। মাঝারি আকৃতির। তাই নাম গোড়ে , বর্ষায় জল টলটল করে কিন্তু চৈত্র বৈশাখে জল শুকিয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকে। অনেকদিন আগে শ্মশানের অভাবে এই পুকুরের গভীরে অসময়ে মৃত শিশু বা বাচ্চাকাচ্চাকে পুঁতে দেওয়া হত। এই রকম ঘটনা মুর্শিদাবাদ ,বর্ধমান কিংবা বীরভূমের মত অনেক জেলার গ্রামেগঞ্জে তখন প্ৰচলিত ছিল, বিশেষ করে সবার পক্ষে তখন উদ্ধারণপুরের শ্মশানে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত না। গ্রামেগঞ্জে এমন পুকুর পাড়ে নাকি বাচ্চা ভূত বা ছানা ভূত দেখা যেত। আজকের গল্পটা এই রকম এক অদ্ভুতুড়ে কাহিনী।
অগ্রহায়ণ মাসের শেষ। হেমন্তকালের শেষ হলেও বাতাসে শীতের আমেজ। সকালে সন্ধেয় হালকা কুয়াশার চাদর সারা মাঠ জুড়ে আড়াল তৈরী করে। চাষীরা বেশিরভাগ জমির পাকা ধান কেটে খামারে এনে রাখছে, ঝাড়াই মাড়াই হয়েছে কিংবা চলছে, এছাড়া কাঁচা-পাকা ধান মাঠেই রয়েছে। এই সময় মাঠের ধান পাহারা দিতে হয় নইলে চোরেরা রাতারাতি ধান চুরি করে নিয়ে যায়। এই ধান পাহারাদারদের বলে আগলদার। তারা মাঠে অস্থায়ী কুঁড়েঘর তৈরি করে থাকে এবং ধান পাহারা দেয়। এছাড়া অনেক চাষী নিজেরাও এই পাহারা দিয়ে থাকে।
দাদুদের বেশিরভাগ ধানী জমি এই গুনোগোড়ের আশেপাশে। তাই এই মাঠের ধান পাহারা দেওয়ার জন্যে আগলদার বা আগুলি রাখা হয়েছে, তবে মাঝে মাঝে বড়দাদু ও ছোটদাদু ভাগাভাগি করে সেই সব দিকেও নজরদারি করতেন। রাতবিরেতে বেরিয়ে দেখতে হত জমির ধান ঠিকঠাক আছে কিনা। নইলে চোরের দল এসে জমির ধান কেটে নিয়ে ভেগে পড়ত। এমন এক হেমন্তের রাত্রে ঘটনাটি ঘটল।
পাড়াগাঁয়ের দিকে রাতের খাওয়া দাওয়া একটু তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। মানুষজন ঘুমাতেও যায় তাড়াতাড়ি। সন্ধেরাতে ছোড়দাদু মাঠ থেকে ফিরে এসেছেন। আপাতত আগলদার মাঠের পাহারায় আছে। তো রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে বড়দাদু মাঠ দেখতে বা’র হলেন। বাড়ি থেকে মাত্র কিলোমিটার খানেক দূরত্ব। আধঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসবেন। রাতের বেলায় মাঠে এলেই মনটা কেমন জানি ভালো হয়ে যায়। গা ছমছম করলেও উঠতি ফসলের ঘ্রাণ, বিশেষ করে ধানের গন্ধ, শিশিরের ঘ্রাণ, আবছা চাঁদের আলো আর কুয়াশা মিলেমিশে এক জাদুজগৎ তৈরী করে যেন। গুনোগোড় পুকুর পাড়ের কাছেই একটা ধানজমির উপরে বাঁশের মাচা বেঁধে একটা কুঁড়েঘর বানানো হয়েছে টাটকা ও ধানী খড়ের সেই ঘরে আগলদার থাকে, জমির ধান পাহারা দেয়। দাদু সেই দিকেই চলেছেন। বেশ কিছুটা পথ তিনি এগিয়ে এসেছেন। আবছা আলোয় আগলদারের কুঁড়ে ঘরটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কুঁড়েঘরের ভিতরে কেরোসিনের টিমটিম বাতি জ্বলছে। দাদুর ডান হাতে একটা তিন ব্যাটারি টর্চ লাইট আছে। রাত বিরেতে টর্চ লাইট ও একখানি বল্লম তাঁর সঙ্গী । পথ দেখা ও নিরাপত্তার জন্যে এগুলো জরুরী। এমন সময় ক্যানেলের দিক থেকে একটা বাচ্চার কান্না শোনা গেল যেন।
বড়দাদু উৎকর্ণ হলেন। কান খাড়া করে প্রতিটি শব্দ শোনার চেষ্টা করলেন।
ক্যানেলের পাড়ে ডাক্তারবাবু যে বাচ্চা ভূতের পাল্লায় পড়েছিলেন এই কথা তো কুঁদুলে গাঁয়ের সবাই জানে। বড়দাদুর মনে হল এই রাতের বেলায় ক্যানেলের দিক থেকে যে বাচ্চার কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে তা বুঝি ওই রকম কিছু। ক্যানেল এর খালের ওপাড়ে মসড্ডার দিকে নিকষ কালো আঁধার। সেই অন্ধকার মাঠে আলেয়া কিংবা অন্যকিছুর আলো জ্বলছে নিভছে। মাঝে মাঝে ফেউ ডাকছে। অনেক দূরে কোথায় শেয়াল ডেকে উঠলো। তারপর খেয়াল করে দেখলেন, বাচ্চাটির কান্নার পরপরই দক্ষিণ মাঠে সিন্দারিগোড়ের কাছে হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া করে একদল শেয়াল ডেকে উঠলো। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ, কোনো শব্দ নেই। তারপর আবার বাচ্চার কান্না শোনা গেল। এবার কান্নার শব্দটা আসছে গুণগোড়ের গভীর থেকে।
মাত্র কয়েকদিন আগে নবান্ন উৎসব গিয়েছে। গুণগোড়ের জল অনেক কমে এসেছে। আশেপাশের চাষের জমিতে সেচের জন্যে এই পুকুরের জল দুনির সাহায্যে তুলে ব্যবহার করা হয়েছে তাই পুকুরে এখন আর সেই টলটলে জল কমে গিয়েছে। কিন্তু তাই বলে পুকুরের গভীর থেকে বাচ্চার কান্না ভেসে আসবে? তা কেন? বড়দাদুর সারা শরীরে শিহরন খেলে গেল যেন ! চমক লাগল। ওটা কি সেই বাচ্চা ভূত, না কি ভূতের ছানা?
তরুণ বয়স। পাড়া গ্রামের মানুষ হলেও বড়দাদু বেশ ডাকাবুকো মানুষ । ভূতের রহস্যটা কী তাঁর জানতে বড় ইচ্ছে হল। তিনি তিনব্যাটারি টর্চের আলো জ্বেলে কান্নার উৎসের দিকে ফোকাস করলেন। প্রথমে কিছুই নজরে পড়ল না। কিন্তু এবার আর কান্নার আওয়াজ বন্ধ হল না। মাঝে মাঝেই সেই কান্নার গমক কানে আসতে থাকল। আগলদার ছেলেটিকে ডাকলেন তিনি, “সুবোধ ,শুনতে পাচ্ছো ?”
সুবোধের কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। তিনি আরো তিন-চারবার হাঁক দিলেন, “সুবোধ , ও সুবোধ , আছো নাকি?”

কী আশ্চর্য ! সুবোধ তো এমন লোক নয় , এক ডাকে সাড়া দেয়। তার কাছে, কেরোসিন বাতি আছে, লাঠি আছে এমন কি তীর ধনুকও আছে। তার তো এমন ভয় পেয়ে চুপ করে থাকার কথা নয় ! দ্বিতীয়ত পরিচিত কিঙ্করদাদা তাকে নাম ধরে ডাকছে ,তাতেও সাড়া নেই কেন ?
বড়দাদু একপা দু’পা করে কুঁড়ের দিকে এগিয়ে গেলেন। আগলঘরের ভিতরে টর্চের আলো ফেলে দেখলেন। বাঁশের মাচার সঙ্গে সুবোধ যেন সেঁধিয়ে গিয়েছে। টর্চের আলো ফেলতেই বোঝা গেল সে ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। বোবা হয়ে গিয়েছে যেন, মুখে কোন কথা নেই। বড়দাদু একটু আশ্বস্তের করার পর সে বলল ,”বড়দা,ওটা সেই ভূতের বাচ্চাটা।”
বড় দাদু বুঝলেন , ভূতের বাচ্চা বলতে সুবোধ সেই অপদেবতা বা ভূতের কথা বলছে যেটা নাকি এই গ্রামের ডাক্তার জনার্দন পালকে ধরেছিল।
সাহস জোগানোর জন্যেই তিনি বললেন ,”ধুস ,পাগল ,ভূত কোথায় ? ভূত বলে কিছু হয়না। আর আমি এতো ডাকলাম তুই সাড়া দিলিনা কেন ?”
সুবোধ বলল ,”বড়দাদা, শুনেছি ভূতেরা নাকি পরিচিত মানুষের রূপ ধরে আসে,তাই ভাবলাম … ”
বড়দাদু বললেন ,”তোর মাথা !, তোকে দিয়ে পাহারা-টাহারা হবে না। তুই একটা ভীতুর ডিম। চিমটি কেটে দেখ আমি জ্যান্ত মানুষ না ভূত। ”
ধমক খেয়ে সুবোধ এবার লজ্জায় জিভ কাটলো। বলল ,”দাদা ,এমনটাই শুনেছিলাম। রাতের বেলা নিশি ডাকে। চেনা মানুষের গলা নকল করে ডাকে। তারপর ডেকে নিয়ে গিয়ে খালে ,বিলে ,পুকুরে বা নদীতে ডুবিয়ে মারে। একটু আগে ক্যালেনের দিকে বাচ্চার কাঁদা তারপর তোমার ডাক শুনে ভাবলাম নিশি ডাকছে, তাই একটু ভয় পেয়েছিলাম।”
“তোর মুন্ডু, তোর ভূত ভাগবো আমি। “- বড়দাদু বললেন। চল কোথায় ভূত দেখে আসি। আমার কাছে বল্লম আছে, তুই তোর কাটারি নে। দুজনেই চল ,ভূতের বাচ্চা কেমন কাছ থেকে দেখব।”
সুবোধ বলল ,”বড়দা তোমার দুই পায়ে পড়ি। আমি যেতে পারবো না। ”
“তাহলে, তুই এখানেই থাক ,আমি চললাম,” বলে এক হাতে বল্লম অন্যহাতে তিনব্যাটারি এভারেডি টর্চ নিয়ে পুকুরের দিকে পা বাড়ালেন।
একটুও যে ভয় পাননি তা নয়, কিন্তু ফালতু ভয় পেলে চলবে না। ভয় পেলে পাহারাদার পালাবে। পাহারা না থাকলে জমির ধান চুরি যাবে। অতএব তিনি সাবধানে পুকুরপাড়ে হাজির হলেন। সত্যিই পুকুরে জল কমে অনেকটাই নিচে নেমে গেছে। ক্যানেলের দিকের পুকুরপাড়ে একটা বাঁশের ঝাড়। আওয়াজটা যেন সেদিক থেকেই আসছে। টর্চের আলো ফেলতে সেখানে কিছু একটা নড়াচড়া করছে বলে মনে হল। আওয়াজটাও যেন সেই জায়গা থেকেই উঠে আসছে।
বড়দাদু মনে মনে ভাবলেন, শুনেছি ওখানে মরা বাচ্চা-কাচ্চাদের একসময় কবরস্থ করা হত বা অগভীর জলায় পুঁতে দেওয়া হত। সেখান থেকেই কি ?
ভাবতে ভাবতে শিরদাঁড়া বেয়ে যেন একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কাদা জলের গভীর থেকে একটা বাচ্চার হাত জেগে আছে না ?
আরো একটু কাছে এগিয়ে গেলেন তিনি।
আরে হাত নয় ,বাঁশের টুকরো কি ?
উহুঁ, বাঁশ নয়। মনে হচ্ছে কাঠের টুকরো। ডেরো কিংবা কোদালের বাট বা হাতল জলের উপর জেগে আছে।
হুম, ঠিক। টর্চের আলোয় বুঝলেন ওটা হাতল তবে দীর্ঘদিন জলের তলায় থাকার ফলে রঙ বদলেছে আর কিছুটা ক্ষয়েও গিয়েছে কিন্তু ওটা হাতল বলেই মনে হচ্ছে । কিন্তু হাতলটা কেন জানি নড়ছে ,একটু একটু করে কাঁপছে। রামনাম করলেন দাদু। শেষ দেখে ছাড়বেন, যা আছে কপালে। ব্যাদা পুকুরে মাছচোর ভূতকে দূর থেকে দেখেছেন।
তাহলে কি পুকুরের গভীরে কিছু আছে যা হাতলটাকে নাড়াচ্ছে ? এবং সেখান থেকেই কান্নার শব্দ আসছে। বড়দাদুর কেমন জানি একটা জেদ চেপে গেছে। আরো এগিয়ে গেলেন। বাশঁতলার কাছে। মনে পড়ল, গ্রামেগঞ্জে লোকজনে বলে বাঁশ গাছে ভূত এসে বসে। পথের উপর বাঁশ ঝুঁকিয়ে মাটির কাছাকাছি এনে প্রায় শুইয়ে দেয়। পথ চলতি মানুষ সেসব খেয়াল না করে সেই শুয়ে থাকা বাঁশ পার হওয়ার জন্যে একটু পা বাড়ালেই বাঁশ সটান খাড়া হয়ে যায়। বিপদে পড়ে সেই সব পথচলতি মানুষ। এসব নাকি ভূতুড়ে খেলা। ভূত বলে কি খেলা ধুলো করতে নেই !
কিন্তু কী করবেন তিনি এবার? বাঁশঝাড়ের কাছে গিয়ে টর্চের আলোটা চারপাশে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেন কোদাল কিংবা ডেরোর হাতলে থকথক করছে কালো কালো পোকা । টর্চের আলোয় মিশমিশে কালো পোকাগুলো জ্বলজ্বল করে উঠলো, সেগুলো কেমন যেন কিলবিল করছে। একটা হিন্দোল উপরের দিকে উঠছে আর সঙ্গে সঙ্গে ক্যাঁআআআআ শব্দ হচ্ছে আবার আরেকটা হিন্দোল নিচের দিকে নেমে কোঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁ শব্দ হচ্ছে। এই ক্যাঁআআআআ এবং কোঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁওঁ ধ্বনি অদ্ভুতভাবে বিমিশ্র হয়ে বাচ্চাদের কান্নার মত শোনাচ্ছে। ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দের থেকেও তীব্র তার আওয়াজ।

বেশ কিছুক্ষণ বড়দাদু থম মেরে থাকলেন। এবার আরেক পাল শিয়াল ডেকে উঠলো দক্ষিণ পশ্চিম কোণের মাঠে তারপর হঠাৎ তিনি একটা দারুন বিষয় উপলব্ধি করলেন , “আরে ছো ছো, জলার উপর জেগে থাকা কাঠের টুকরো বা কোদাল-ডেরোর থেকে যে আওয়াজ হচ্ছে তা কিনা বাচ্চার কান্না বলে ভ্রম হয়। কি কান্ড ! ওগুলো তো পোকাগুলোর সম্মিলিত আওয়াজ !”
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্ত উপন্যাসে শ্মশানে শকুনের বাচ্চার কান্নাকেও শ্রীকান্ত মানুষের বাচ্চার কান্নার মত শুনেছিলেন। মন বোধ তাঁর মনের মধ্যে এসেছিল বোধহয়।

এতক্ষণে কান্নার স্বরূপ বুঝতে পেরে তিনি এবার কুঁড়েঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর আগলদারকে ডেকে বললেন , “চল সুবোধ, তোকে এবার ‘না-ভূত’ দেখাবো। ”

তবে গল্পটা এখানেই শেষ নয়। বেশ কয়েক দশক পরে ওই পুকুরের পাড়ে যখন সাবমার্সিবল পাম্প বসানো হয় তখন মাটির গভীর থেকে বেশ কিছু হাড়গোড় উঠেছিল। প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সেগুলো নাকি মানুষেরই। আমি এবিষয়ে এর বেশি কিছু জানতে পারিনি অবশ্য।

 

……০……

Leave a comment

Check Also

স্বীকারোক্তি

স্বীকারোক্তি- ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য্য

    আজই ফোনটা ডেলিভারি দিয়ে গেলো। অনলাইনে একবার দেখেই ভারি পছন্দ হয়ে গেছিল সমীর …

দর্পণে

দর্পণে – নির্মাল্য ঘরামী    

    -চল, আমি জোরের সঙ্গে বললাম, -ওসব একদম ভাবিস না। তোকে এতদিন পরে পাচ্ছি, …

ফয়সালা

ফয়সালা – নির্মাল্য ঘরামী

  -দেখুন স্যার। বলে সিকিউরিটি গার্ডটি বিজয়ীর দৃষ্টিতে মহাকুলসাহেবের দিকে তাকালো। তার হাতে ধরা ব্যাগটির …

রক্তগোলাপ/ মৌসুমী পাত্র/ পুণ্যতোয়া ধর

রক্তগোলাপ – মৌসুমী পাত্র

  একটা মোটা দড়ি থেকে পাশাপাশি ঝোলানো সারি সারি মৃতদেহ। ছাল ছাড়ানো। গত কদিন ধরেই …