(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
বাঘুর প্রাণে ক’দিন ধরেই বেজায় দুঃখ। বনের ভেতর উতলধারায় বৃষ্টি নামছে যখনতখন, গাছপালাগুলো মাথা ঝাঁকিয়ে ভিজছে খুশি খুশি ভঙ্গিতে। সারাদিন কিচিরমিচির করে বেড়ানো পাখিরা, ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানো প্রজাপতিরা এদিক সেদিক গুটিশুটি মেরে বিশ্রাম করছে পাতার আড়ালে আবডালে। ব্যাঙগুলোও বৃষ্টিতে ভিজে টইটুম্বুর হয়ে মনের সুখে গলা ছেড়ে গান গাইছে! এমনকি, মায়েরা, বাবারা কাজে বেরোচ্ছে না সবসময়। একথালা করে খিচুড়ি খেয়ে আরাম করে বৃষ্টির গান শুনতে শুনতে ঘুমোচ্ছে!
আর বাঘুর বেলা? তাকে রোজ পাঠশালেও আসতে হচ্ছে, পড়াও করতে হচ্ছে, দিদিমণির বকুনিও খেতে হচ্ছে! কোথায় এমন বাদলদিনে দুপুরে খাওয়াদাওয়া করে গায়ে চাদর টেনে আরামে ঘুমোবে, তা না!
পাঠশালার পড়া চলতে চলতেই বিভোর হয়ে এসব গুরুতর কথা ভাবছিল বাঘু। দুঃখের কী আর শেষ আছে তার? এই যেমন এখন, ঘুম পাচ্ছে বেজায়। কিন্তু ঘুমোনোর কি জো আছে? এক্ষুণি দিদিমণি হয়তো ‘ঘুমে’র উপরই রচনা লিখতে দিয়ে দেবেন! আর ঘুম তো পাচ্ছে দিদিমণিরই জন্য। গরমাগরম তালের বড়া ভেজে টিফিনের সময় খাইয়েছিলেন সকলকে। তা বলতে গেলে, নেহাত মন্দ খায়ওনি বাঘু। একে নিজের টিফিন, তার উপর ডজন দুয়েক তালের বড়া- এত খেয়েদেয়ে যদি ঘুম পায়, সেটা কি বাঘুর দোষ?
দিদিমণি বোর্ডে অঙ্ক করতে ডাকছেন একে একে। আর এমনই কপাল খারাপ তার যে কিসের জন্য ডাকছেন দিদিমণি, তাই ভালোমতো মাথায় ঢোকেনি। দিদিমণি এদিকে বোর্ডে যোগ করতে দিয়েছেন, ৪+৪=___ । ঘুমচোখে বাঘু এগিয়ে যেতেই দিদিমণি হাতে চক ধরিয়ে দিয়ে বলেছেন, “লেখ, বাঘু।”
তা ঘুমের ঘোরে একটু আধটু ভুলচুক হওয়া কি অন্যায়? দিদিমণি ‘লেখ, বাঘু’ বলাতে বাঘু ঘুমের ঘোরে ভেবেছে, দিদিমণি বোধহয় ‘বাঘু’ লিখতে বলেছেন। তাই সেও লিখল, ৪+৪= বাঘু।
এইটুকুনি মোটে ভুল, কিন্তু তার জেরেই বাঘুকে ষোলোবার লম্বাগুড়ি দিতে হল। শুধু তাই নয়, অত সুন্দর যে ঘুমের যে চটকাটা এসেছিল, সেটাও গেল চটকে।
তা এরকম হলে কার না রাগ হয়? সেই রাগে বাঘু খানকয়েক কাগজের গোল্লা পাকাল খুব মন দিয়ে। তারপর একটা কাগজের গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ল ভালকির দিকে। ভালকি একবার তাকাল পিছনের দিকে কিন্তু বাঘু ততক্ষণে মন দিয়ে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটছে। হাতুশি ওদিকে লিখতে গেছে বোর্ডে। দিদিমণিও সেদিকে তাকিয়ে। একটু পরে বাঘু আরেকটা গোল্লা ছুঁড়ল হিনিমিনির দিকে। কিন্তু যেই না কাগজের টুকরোটা হিনিমিনির দিকে ছুঁড়েছে বাঘু, অমনি বাঘুর লেজে এক টান। বাঘু ব্যাপারটা ভালো বুঝল না। আবার একটা গোল্লা ছুঁড়ল ভালকির দিকে। সে তখন দিদিমণির কাছে কিছু একটা পড়া দেখাতে গেছে। ভালকির গায়ে গোল্লাটা লাগল বটে, কিন্তু তার মন তখন দিদিমণির দিকে। তাই সে গায়ে লাগাটা ঠিক বুঝল না। এদিকে বাঘুর লেজে আরো এক টান পড়েছে। বাঘু তাকিয়ে দেখে, কুমরু মিটিমিটি হাসছে। বাঘু চোখ পকাল, “কুমরু, তুই আমার লেজ টানছিস যে বড়?”
কুমরু ফ্যাক করে একবার হেসে থাবা দিয়ে মাথাটা একবার চুলকে নিয়ে বলল, “আচ্ছা, লেজ টানা বারণ বুঝি? তাহলে কী টানব? তোর কান?”
বাঘু মুখ গোঁজ করে বলল, “না, কানও টানবি না! দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি।”
বলতে না বলতেই কুমরুর লেজ ধরে বাঘু দিয়েছে পাল্টা এক টান। কুমরু ইচ্ছে করেই এক চিল চিৎকার ছেড়েছে। আর কুমরুর লেজ পুরো কাঁটা ভর্তি। ফলে বাঘুর হাতেও লেগেছে বেজায়।
কুমরুর চিৎকার শুনে শিয়ালনী এগিয়ে এসেছে, “কুমরু, কী হয়েছে রে?”
কুমরু হাঁউমাঁউ করে উঠল, “দিদিমণি, এই বাঘুটা আমার লেজ ধরে টান দিয়েছে।”
শুনেই শিয়ালনী রেগে কাঁই, “বাঘু, আবার তুই গোলমাল শুরু করেছিস? ওর লেজ ধরে টেনেছিস কেন?”
বাঘু থাবা দিয়ে লেজটা একবার চুলকে নিয়েই বলল, “দিদিমণি, আপনি খালি আমার দোষই দেখেন! আর ওর লেজ টানতে গিয়ে আমার থাবায় যে কাঁটা ফুটে গেল, সেটা?”
শিয়ালনী মাথা ঝাঁকাল, “বেশ হয়েছে। যেমন কর্ম, তেমন ফল। কিন্তু তুই ওর লেজ ধরে টানতে গেলি কেন?”
বাঘু বলল, “বা রে! ও আমার লেজ ধরে টানছিল কেন?”
কুমরু ফোঁস করে উঠল, “দিদিমণি, বাঘু না কাগজের গোল্লা পাকিয়ে ছুঁড়ছিল সবার দিকে। তাই ওকে একটু শিক্ষা দিলাম।”
বাঘু খুব গম্ভীর স্বরে কুমরুর দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল, “তোর থেকে শিক্ষা পেতে এখানে আসিনা, বুঝলি? আমি দিদিমণির থেকে শিক্ষালাভ করতে এখানে আসি, বুঝলি?”
শিয়ালনীর চোখ বড়োবড়ো হয়ে প্রায় কপালেই ঠেকে গেল, “অ্যাঁ? কী বললি, বাঘু? ক্কী বললি? আমার থেকে শিক্ষালাভ করতে এখানে আসিস, না? তা বৎস বাঘু, আমি কি এই শিক্ষাদান করে থাকি? কাগজের গোল্লা ছোঁড়া?”
বাঘু গালে লেজখানা ঠেকিয়ে বেজায় চিন্তার সুরে বলল, “তা অবশ্য ঠিক দিদিমণি… আপনাকে কোনদিন কাগজের গোল্লা ছুঁড়তে দেখিনি। একবার ছুঁড়ে দেখবেন দিদিমণি? খুব মজা লাগবে!”
শিয়ালনী কিরকম যেন রেগে গেল, “বাঘু! তোর মজা আমি বের করছি। রোজ রোজ পড়া পণ্ড করার মতলব তোর?”
বাঘু অমনি মুখে থাবা ঘষতে ঘষতে উত্তর দিল, “রোজ রোজ কোথায় পড়া পণ্ড করি, দিদিমণি? এ সপ্তাহে বলে মোটে একদিনও পড়া পণ্ড করতে পারিনি। আজ বৃহস্পতিবার হয়ে গেল! ও হো হো হো!”
বলেই বাঘু প্রায় ডাক ছেড়ে কান্না শুরু করে দিল। শিয়ালনী ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেছে রীতিমতন। বাঘু চিৎকার করে কেঁদে যাচ্ছে তো কেঁদেই যাচ্ছে, “ও হো হো হো! একদিনও এ সপ্তায় পড়া পণ্ড করতে পারলাম না গো!”
বেগতিক দেখে হাতুশি এগিয়ে এসেছে, “দিদিমণি, আপনি কিচ্ছুটি ভাববেন না। আমরা যা ব্যবস্থা করার করছি।” বলেই হাঁক দিল হাতুশি, “হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু- তোরা এদিকে আয় তো। বাঘুকে চ্যাংদোলা করে নিয়ে যাই।”
হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি আর কুমরু মিলে এমন চটপট চ্যাংদোলা করে নিয়ে চলল যে বেচারি বাঘু বিস্তর থাবা ছোঁড়ার চেষ্টা করেও কিছু করতে পারল না। শিয়ালনী চেঁচাচ্ছে এদিকে পেছন থেকে, “ওরে হাতুশি, দেখিস- বাঘুর যেন লেগেটেগে না যায়।”
ওরা চারজনে মিলে বাঘুকে নিয়ে গেল কিছুদূরের একটা আমগাছের কাছে। তারপর হাতুশি বসল থাবামুড়ে। হাতুশির পিঠের ওপর বসিয়ে দেওয়া হল বাঘুকে। ভালকি ধরে রইল বাঘুকে। তারপর হাতুশি উঠে দাঁড়িয়ে শুঁড়ে করে বাঘুকে হালকা করে জড়িয়ে নিল। তারপর তুলে দিল মাথার ওপর দিকে। এদিকে গাছের ডালে হিনিমিনি তৈরিই ছিল। বাঘুকে টেনে বসিয়ে দিল একটা গাছের ডালে। ব্যস, বাঘুর জারিজুরি খতম। না পারছে গাছ বেয়ে নামতে, না পারছে লাফ দিতে।
বাঘু রীতিমতো হাঁউমাঁউ জুড়েছে, “ওরে, হাতুশি রে! ওরে হিনিমিনি রে! আমাকে নামিয়ে দে রে! আমার খুব লেজব্যথা করছে রে! আর সপ্তাহে সপ্তাহে পড়াশুনো পণ্ড করবো না রে! দু’ সপ্তাহে একবার করে পড়া পণ্ড করব রে!”
তা ওসবে কি আর ওরা ভোলে? বাঘুকে আমগাছের উপরেই রেখে ওরা ফিরল পাঠশালায়। শিয়ালনী খুব উদ্বিগ্ন, “হ্যাঁ রে, বাঘুকে কোথায় রেখে এলি তোরা?”
ভালকিই খুলে বলল সব। সব শুনে শিয়ালনী বলল, “ঠিক আছে, একটুখানি ও তাহলে আমগাছের উপরই থাকুক। তাতে যদি কিছু শিক্ষা হয়! এখন নে, সবাই ‘জন্তু জগৎ’ বইটা খোল।”
‘জন্তু জগৎ’ বইটা ওদের কিছুক্ষণ পড়াল শিয়ালনী। পড়ানো হয়ে গেলে লিখতে দিল। তারপর শিয়ালনী চলল বাঘুর খোঁজে। বাঘুর জন্য সত্যিই তার চিন্তা হচ্ছিল।
এদিকে বাঘু প্রথমটায় বেশ খানিক চিৎকার চেঁচামেচি করে যখন বুঝে গেল যে হাতুশিরা আর কোনমতে ফিরবে না, তখন সে আমগাছের কাণ্ডে হেলান দিয়ে একটা ডালে দুটো থাবা ছড়িয়ে দিয়ে আরাম করে বসল। যাক্, এটুকু তো অন্ততঃ ভালো হয়েছে যে এখন আর কেউ তাকে জ্বালাতে আসবে না। মনের সুখে একটা গানই জুড়ল বাঘু-
ভোঁপ ভোঁপ ভোঁপ
বেগুনঝোপে কোপ।
কাঁচকলা আর সুজি খেলে
গজিয়ে যাবে গোঁফ!
আহা! গজিয়ে যাবে গোঁফ!
গোঁফের ওপর বসলে মাছি
মুশকিল যে ভারি-
দিও তখন কষে হাঁচি
মুখটি করে হাঁড়ি।
আহাহা! মুখটি করে হাঁড়ি…
আর… হাঁড়ির গায়ে ছোপ
আহা! গজিয়ে যাবে গোঁফ
আর… হাঁড়ির গায়ে ছোপ,
ওরে, বেগুনঝোপে কোপ…
গানটা বেশ দরদ দিয়ে একবার গাইল, দুবার গাইল, তিনবার গাইল বাঘু। তারপর আমগাছের ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়ায় বড় বড় হাই উঠতে শুরু করল বাঘুর। ধীরে ধীরে চোখের পাতা মুদে এল বাঘুর আর ফুৎ ফুৎ করে নাক ডাকতে শুরু করে দিল।
বাঘুর ঘুমটাও ধরেছে আর এদিকে সেসময় শিয়ালনীও পৌঁছেছে আমগাছের তলায়। কিন্তু হলে হবে কী, খানকয়েক ডেঁয়ো পিঁপড়ে অ্যায়সান কামড় দিল বাঘুকে যে থাবা আলগা হয়ে বাঘু, পড়বি তো পড়, পড়ল একেবারে শিয়ালনীর গায়ের উপর!
আচমকা ঘাড়ের ওপর ওরকম একটা ওজনদার জিনিস এসে পড়ায় হাঁউমাঁউ করে বিকট এক চিৎকার ছাড়ল শিয়ালনী। বাঘুর অবশ্য অতটা লাগেনি, দিদিমণির গায়ের ওপর পড়েছে কিনা। একটুখানি সামলে নিয়েই চোখ পিটপিট করল বাঘু, “দিদিমণি, আপনি বুঝি ভয় পেলেন? ভয় পাবার কিছু নেই, আমি বাঘু।”
ভয়ংকর এক গর্জন ছাড়ল শিয়ালনী, “ক্কী, কীঈঈঈ! তুই আমাকে সাহস যোগাতে এসেছিস? তুইইই?”, বলতে বলতেই ধুলোটুলো ঝেড়েঝুড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে শিয়ালনী, “চালাকি পায়া হ্যায়, না বাঘু বাছাধন? খুব কায়দা করে আমার ঘাড়ে পড়া হয়েছে, না?”
বাঘুর তাতেও হেলদোল নেই। গালে থাবা বুলোতে বুলোতেই উত্তর দিল, “না দিদিমণি, কায়দা না করেই পড়েছি। কায়দা করলে তো অন্যরকম ভাবে পড়তাম। আমাকে আরেকটিবার গাছে তুলে দেবেন দিদিমণি? তাহলে কায়দা করে পড়াটা দেখাতাম!”
“ইসসস! কায়দা করে পড়াটা দেখাতাম!”, শিয়ালনী প্রায় ভেংচেই ওঠে আর কী, “কিন্তু তুই বেমক্কা আমার ঘাড়ে পড়লি কেন? পাঠশালা পণ্ড করার মতলব? না?”
বাঘু এবারে প্রায় তোতলাতেই শুরু করে দিল, “ইয়ে… মানে… হ্যাঁ দিদিমণি… মানে না দিদিমণি… মানে ইয়ে… মানে ওই একটু ঘুম… মানে ঠিক ঘুমও নয়… মানে ইয়ে… মানে একটু চোখ লেগে গিয়েছিল আর কী…।”
এতই রেগে গেল শিয়ালনী যে রাগের চোটে তার গা থরথর করে কাঁপতে থাকল, পেট গুরগুর করতে থাকল, কান কুরকুর করতে থাকল, লেজ লুড়লুড় করতে লাগল। আর তার নাকের সামনে একটা ফড়িং পিনপিন করে ঘুরতে থাকল তো ঘুরতেই থাকল। কোনমতে বলল শিয়ালনী, “ও, খুব ঘুমের ধুম হয়েছে না? হতভাগা, কোথায় তোকে শায়েস্তা করার জন্য গাছে তোলা হল, তা না, আরামে ঘুমিয়েছে এতক্ষণ! চল গর্দভ, তোকে এবার পড়ার কায়দা আমি শেখাচ্ছি। মানে পড়াশোনার কায়দা। টিফিনের সময় আজ আর কোথাও যেতে পারবি না। আমার সামনে বসেই টিফিন খাবি আর আমার সামনে বসেই পড়বি। ‘জন্তু জগতে’র বাকি পড়াগুলো তোকে পড়াবো।”
বলেই বাঘুর লেজ ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলে গেল শিয়ালনী। বেচারি বাঘু আর কিছু বলার বা করার সুযোগই পেল না।
পরের দিন ওদের পাঠশালার বার্ষিক বর্ষাভোজ। প্রতি বছরই একটা ভালো বর্ষার দিন বেছে পাঠশালার সব পশুয়াদের (পশুয়া= পশু+পড়ুয়া) নিজে রান্না করে খাওয়ায় শিয়ালনী। খিচুড়ি, বেগুনি, আলু-মটর আর ইলিশ মাছ ভাজা। শেষপাতে পেঁপের চাটনি। বেশি পড়াশুনাও হয়না সেদিন। হালকা হালকা পড়াশুনা হয়। খেলাধূলা, মজা, নাচানাচি হয়।
প্রার্থনার পর খুশি খুশি মনে ক্লাসে এসে বসেছে ওরা। দিদিমণি ক্লাসে এসে ঢুকতেই হিনিমিনি আবদারের সুরে বলল, “দিদিমণি, আজা আমাদের মজাদার কিছু পড়ান না!”
শিয়ালনীরও মন খুশি খুশি। চশমাটাকে চোখে ভালো করে সেঁটে বলল, “আচ্ছা বেশ। তোদের বরং আজ ‘জন্তু জগৎ’ বই থেকে ইয়েতির অধ্যায়টা পড়াই।”
কুমরু হাঁ হয়ে গেল, “দিদিমণি, ইয়েতি আবার কী? ইয়েতি কি হাতির মাসতুতো দিদি?”
শিয়ালনী ফিক করে হাসল, “হাতির মাসতুতো ভাই কিনা পড়লেই জানতে পারবি।”
বাঘু সুযোগ পেয়ে বায়না জুড়ল, “দিদিমণি, আমার একটা ইয়েতি চাই। আমি পুষবো।”
ভয়ানক চমকে গেল শিয়ালনী, “ক্কী? ক্কী বললি, বাঘু? ইয়েতি পুষবি? তুইইইই?”, বলেই পেট চেপে বেজায় হাসতে শুরু করে দিল শিয়ালনী, “বাঘু বাছাধন, ইয়েতির সঙ্গে মোলাকাত হলে তোমায় আর ইয়েতি পুষতে হবে না। তোমাকেই বরং ইয়েতি পুষবে।”
এ কথায় বাঘু বাদে সব পশুয়ারাই হোহো করে হাসতে হাসতে শুরু করে দিল। বাঘুর বেজায় মানে লাগল। মুখ গোঁজ করে জবাব দিল, “তোদের মতন সব বন্ধুদের সঙ্গে থাকার চাইতে ইয়েতির কাছে থাকাও ঢের ঢের ভালো। বুঝেছিস?”
শিয়ালনী দেখে, আবার একটা ঝগড়া বাধে বুঝি! তাড়াতাড়ি করে সামাল দিল, “চুউপ! আমি এখন ‘ইয়েতি’ পড়ানো শুরু করবো। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি।”
শুনে সবাই বসলো জড়োসড়ো হয়ে। শিয়ালনীও পড়ানো শুরু করলো-
ইয়েতি এক অতি আশ্চর্য জন্তু। বিশাল কালো লোমশ চেহারা, আকৃতিতে ভালুকের চেয়ে অনেকটাই বড়ো। দেখলেই ভয় লাগে। হিমালয়ের খুব দুর্গম এলাকায় রহস্যজনক পায়ের ছাপ দেখা গেছে অনেক সময়। স্থানীয় জন্তুজানোয়ারদের দাবী, ওই ছাপগুলি সবই ইয়েতির অর্থাৎ তুষারমানবের। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যাবোমিনেবল স্নোম্যান’। মানুষ বা ভালুকের পায়ের ছাপ যেমন হয় অনেকটা তেমনই, কিন্তু আকারে অনেকটাই বড়ো। কিছু কিছু পশু অবশ্য ইয়েতি দেখেছেও বলে দাবী করেছে। তাদের মধ্যে আছেন পশুকুলের বিখ্যাত বিজ্ঞানী মাননীয়া ওরাংওটাংচি। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি একবার দুষ্প্রাপ্য কিছু গাছগাছড়ার খোঁজে হিমালয়ের অনেক উপরে এক প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়েছিলেন। সেখানেই তিনি ইয়েতির দেখা পান। তবে ইয়েতি তাঁর বিশেষ ক্ষতি করেনি। খালি মাথায় চাঁটি মেরে গাছগাছড়াগুলি কেড়ে নিয়েছিল। সেইজন্যই তিনি আর জন্তুদের আরেকটি করে লেজ গজানোর ওষুধ বের করতে পারেননি।
এই পর্যন্ত পড়িয়ে বুঝিয়ে টুঝিয়ে শিয়ালনী রান্নার জোগাড় করতে চলে গেল।
খাওয়াদাওয়া হল বেশ মজাসেই। সকলেই আরাম করে পেটপুরে খেল। বাঘু কুমরুর পাতের থেকে একটা মাছ কেড়ে নিয়ে খেতে গিয়েছিল, কিন্তু কুমরুও তক্কে তক্কে ছিল। এক থাবড়া মেরে বাঘুর পাতের থেকে একটা মাছ কেড়ে নিল সঙ্গে সঙ্গে। ব্যস, শোধবোধ। হিনিমিনির থেকে বেগুনী কেড়ে নিতে গিয়েও একই অবস্থা হল বাঘুর।
তা এমন পরিপাটি খাওয়াদাওয়ার পর পেট ভারি হয়ে সবারই অল্পবিস্তর ঘুম পায়। খাওয়াদাওয়ার পাট শেষে শিয়ালনী আসতেই ভালকি বলল, “দিদিমণি, আজ একটা ঘুমের ক্লাস হলে কেমন হয়?”
শিয়ালনী মাথা দোলাল, “ভালোই হয়। ঠিকই বলেছিস। শোন সবাই, আজ এখন ঘুমের ক্লাস। সবাই মন দিয়ে ঘুমোবি। কেউ ফাঁকি দিবি না। বুঝলি?”
হিনিমিনি বলল, “গাছের ডাল ছাড়া আমার ঠিক ঘুম হয় না। আমি বরং গাছের ডালেই যাই। আপনি ডাকলে নেমে আসবো দিদিমণি।” হিনিমিনি গাছের ডালে চলে গেল। হাতুশির শুঁড় দিয়ে জোর আওয়াজ। বাঘু একবার কাছাকাছি যেতে গিয়ে হাওয়ার চোটে উল্টেই গেল। বাঘু চোখ পিটপিট করে দেখল, কুমরু ঘুমোয়নি। বাঘু তখন গান জুড়ল-
ঘুমপাড়ানি মাসিপিসী কুমরুর বাড়ি এসো,
খাটি নেই, পালং নেই, কুমরুর কাঁটায় বোসো।
নদী ভরা মাছ দেবো, ভেজে তুমি নিও।
কাদাভরা ডাঙা দেবো, আছাড় তুমি খেয়ো।
শিয়ালনী এদিকে গেছে হাতুশির নাক ডাকা থামাতে। থামাতে গিয়ে হাতুশির শুঁড়ের বাতাসের ঠেলায় নিজেই উল্টে গিয়ে পড়ল ভালকির কোলে। ভালকি তখন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল তার পুতুলের। শিয়ালনী তার কোলে এসে পড়তেই গায়ে হাত বুলিয়ে ঘুমের ঘোরেই বলল, “ও আমার সোনা পুতুলটা! ও আমার মিষ্টি পুতুলটা। রাগ করে না সোনা, আমি এই চানটা সেরে এসেই তোমাকে ভাত খেতে দেবো।”
শিয়ালনী চেঁচিয়ে বলল, “ভালকি! আমি পুতুল নই, আমি দিদিমণি!”
ভালকি ঘুমের ঘোরেই আলতো হেসে বলল, “ও! তুমি আমার চিনিমিনি! তাই তো বলি, আমার চিনিমিনি সোনা কত্ত বড়ো হয়ে গেছে! ও চিনিমিনি, তুমি কি আমাদের পাঠশালে পড়াবে? চলো তোমাকে আদর করি। আমার চিনিমিনিটা, আমার পিচিম পিচিমটা!” বলেই চকাম করে একটা চুমু ছুঁড়ল হাওয়ায়।
শিয়ালনী মুখের কাছে দুই থাবা জড়ো করে জোরে চেঁচাল, “ভালকি, আমি পুতুল নই, আমি শিয়ালনী দিদিমণি।”
ঘুমের ঘোরেই ভালকি ফিক করে হাসল, “ও চিনিমিনি! কত্তো মিষ্টি তুমি! আবার দিদিমণির মতো গলা করে বকুনি দিচ্ছ কেন? ও বুঝেছি! তুমি এখন দিদিমণি সাজতে চাও, তাই না চিনিমিনি? আমরা এখন দিদিমণি দিদিমণি খেলি- তাই চাইছ তুমি, না? আচ্ছা বেশ, আগে আমি দিদিমণি হই?”
ভালকি থামতেই শিয়ালনী জোরে ধমক দিল, “ভালকি, আমি সত্যিই তোর দিদিমণি। চোখ খোল্।”
ভালকি আবারো মিষ্টি মিষ্টি হাসল ঘুমের ঘোরে, “ও ব্বাব্বা! তুমিই দিদিমণি হবে, তাই না চিনিমিনি? আচ্ছা বেশ, তোমার যখন অতোই দিদিমণি হবার শখ- তুমিই হও।”
শিয়ালনী হাঁক দিল, “ভালকি, চোখ খুলবি?”
ভালকি ঘুমের ঘোরেই মাথা দোলায়, “ও ব্বাব্বা! বড়ো বড়ো চোখ করে দিদিমণির মতন ভয় দেখানো হচ্ছে! কত রঙ্গই জানে জাদুধন! চলো, তোমাকে একটা হামি খাই।”
বলতে না বলতেই চকাস করে একটা হামি পড়ল শিয়ালনীর গালে।
শিয়ালনী গালে থাবা বুলোতে বুলোতেই এক ঝাঁকুনি দিল ভালকিকে, “ভালো করে দ্যাখ, ভালকি। আমি দিদিমণি।”
ভালকি অল্প অল্প চোখ খুলল। তখনও তার স্বপ্নের ঘোর কাটেনি। মিটিমিটি করে চাইল ভালকি, “ও চিনিমিনি! আবার দিদিমণির মতো করে সেজে আমায় ভয় দেখানো হচ্ছে না? বড্ডো পাজি হয়ে গেছ তুমি!”
শিয়ালনী ভালকির চোখেমুখে খানিক জলের ঝাপটা দিল, “ভালকি, ভালো করে দ্যাখ। এই যে আমি, তোর দিদিমণি।”
ভালকি চোখ পিটপিট করলো, “চিনিমিনি, এ কিরকম চেহারা করেছিস রে… দিদিমনি দিদিমণি লাগছে যে… এ কী, এ যে সত্যিই দিদিমণি!”
শিয়ালনী কোমরে হাত দিয়ে হাসল, “হ্যাঁ, সত্যিই দিদিমণি!”
ভালকি উঠে দাঁড়াল, “দিদিমণি, আমি বোধহয় স্বপ্ন দেখছিলাম।”
বাঘু ওদিকে হাতুশির নাক ডাকার ঠ্যালায় কিছুটা দূরে গিয়ে শুয়েছে। মাঝেমাঝেই চোখের পাতা অল্প অল্প করে ফাঁক করে দেখছে চারপাশের অবস্থা। হিনিমিনি বোধহয় গাছের ডালে আরামে ঘুমোচ্ছে। কুমরুটাও মনে হয় ঘুমিয়ে গেছে। দিদিমণি ভালকির থাবা থেকে বেরোনোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। বৃষ্টির আদরমাখা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বাতাস বইছে জঙ্গলের মধ্যে। আহহ্, কী আরাম! আকাশে পালে পালে মেঘেরা চলেছে। যেন একটা বরফের দেশ! হঠাৎ করে যেন বরফ পড়তে থাকল আকাশে। চারপাশ ঢেকে গেল বরফে। গাছপালা ঢেকে গেল বরফে। দিদিমণি একটা করে শাল দিলেন সবাইকে- নে, গা মাথা সব ভালো করে মুড়ি দিয়ে বোস।
বাঘু সবে ভালো করে ঢাকাঢুকি দিয়ে নামতা বইটা হাতে নিয়েছে, অমনি কে যেন পেছন থেকে ভারি মোটা গলায় ডাকল, “এই যে খোকাবাঘ, এটা কি পাঠশালা? লেখাপড়া শেখানো হয়?”
খোকাবাঘ বলায় বাঘুর ভয়ানক রাগ হল, কিন্তু পেছনের দিকে তাকিয়ে যা দেখল, তাতে তার আক্কেলগুড়ুম! সেখানে দাঁড়িয়ে আছে- একটা বিশাল চেহারার ভয়ংকর প্রাণী। মাথাটা প্রায় আমগাছের ডালে গিয়ে ঠেকেছে যেন। মানুষ আর ভালুকের মাঝামাঝি চেহারা।
বাঘু আঁ আঁ করে বিকট এক চিৎকার জুড়তে যাবে, এমন সময় প্রাণীটা দাঁত বের করল, “কী খোকাবাঘ, ইয়েতি কখনো দেখোনি বুঝি?”
বাঘু বেচারি ভয়ের চোটে একদফা থাবাপ্রণামই সেরে ফেলল, “আরে না না ইয়েতিদিদি, আপনি নিজে আসবেন বুঝবো কী করে? আমাকে একটিবার ডাকলেই তো আমি চলে যেতুম।”
ইয়েতি হাসল, “এই কি তোমাদের পাঠশালা? দিদিমণিকে একবার ডাকা যাবে?”
তা শিয়ালনীকে আর ডাকতে হল না। সে নিজেই এসে উপস্থিত। “কী ব্যাপার বাঘু, কার সঙ্গে এত কথা বলছিস?”
বলতে না বলতেই ইয়েতির দিকে তাকিয়ে শিয়ালনীর মুখচোখ হাঁ। কী করবে, কী বলবে কিছুই যেন খুঁজে পাচ্ছে না। ইয়েতি মাথা নাড়িয়ে মোলায়েম করে হাসল, “নমস্কার, দিদিমণি। আমি ইয়েতি। আপনি আমাকে মিস ইয়েতি বলেও ডাকতে পারেন।”
শিয়ালনী কথা কইবে কী, সে থরথর করে কাঁপছে। ইয়েতিই বলল, “দিদিমণি, আপনি আমায় চাট্টি লেখাপড়া শেখাবেন? আসলে আমি নিরক্ষর জন্তু বলে ভারি মুশকিলে পড়ছি। অল্প একটু শিখিয়ে দেন। তাইলেই হবে।”
বেচারি শিয়ালনী আর কী করে? একটা কাগজে অ আ এসব লিখেটিখে দিল ইয়েতিকে। তারপর ইয়েতির হাতে একটা পেনসিল ধরিয়ে দিয়ে বলল, “মিস ইয়েতি, তুমি এই পেনসিল দিয়ে লেখার ওপর বুলোতে থাকো।”
ইয়েতি অমনি বাঘুর পাশে বসে বসে পেনসিলের পিছনদিকটা দিয়ে বুলোতে শুরু করল। বাঘু হাঁইমাঁই করে উঠল, “আরে ওদিক দিয়ে পেনসিল বুলোনো যায় নাকি? এই সামনের ছুঁচলো দিকটা দিয়ে বোলাতে হয়।”
ইয়েতি কেমন যেন থতমত খেয়ে গিয়ে বলল, “ও! আসলে এই দিকটা কেমন কালো কালো বিচ্ছিরিমতন আর পেছনদিকটা কী সুন্দর হলুদ রঙ- তাই ওদিক দিয়েই চেষ্টা করছিলাম।”
সুযোগ পেয়ে বাঘু ইয়েতিকেই চোখ পাকিয়ে দিল, “আরে ধুস, ওরকম করে নাকি? তুমি এদিক দিয়ে বোলাও।”
হাতের সবকটা আঙুল দিয়ে মুঠো করে পেনসিলটা ধরল ইয়েতি। তারপর এমন জোরে বোলাতে শুরু করল যে পেনসিলের শিসই গেল ভেঙে। বাঘু দাঁত মুখ খিঁচোল, “নাও, এবার পেনসিল ছোলো। এই নাও, পেনসিল ছোলার কল।”
ইয়েতি এমন পেনসিল ছুলতে আরম্ভ করল যে পেনসিলই গেল ভেঙে। তাই দেখে এগিয়ে এসেছে শিয়ালনী, “মিস ইয়েতি, মা, তোমাকে আমি বরং গাছের এই ডাল দিচ্ছি। তুমি মাটিতে আঁচড় কাটো।”
ইয়েতি মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ দিদিমণি, সেই ভালো। আমার বেশি লেখাপড়ারও দরকার নেই। আপনি বরং আমাকে নাম সই করতে শিখিয়ে দিন, তাইলেই হবে।”
শিয়ালনী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল এ কথায়। মাটিতে বড়ো বড়ো করে লিখে দিল- ইয়েতি! আর ইয়েতিও তার উপরে সমানে গাছের ডাল বোলাতে থাকল।
একটু পরেই ইয়েতি হাত নেড়ে শিয়ালনীকে ডাকল, “দিদিমণি, আমি শিখে গেছি। আজ তাহলে আসি। দরকার হলে পরে আবার আসবো।”
বাঘু কাঁউমাঁউ করে উঠলো, “না ইয়েতিদিদি, তুমি যেও না। আমি তোমাকে পুষবো। আমার বলে একটাও ইয়েতি নেই।”
তাই শুনে ইয়েতি আকাশবাতাস কাঁপিয়ে ভীষণ জোরে গর্জন করে উঠল, “বাঘু! বাঘুউউউউ!”
বাঘু ইয়েতির হাত জোরে চেপে ধরল, “না ইয়েতিদিদি, তোমায় যেতে তো দেবো না। তোমার পিঠে চড়েই রোজ পাঠশালায় আসবো।”
তাই শুনে ইয়েতি আবার আকাশবাতাস কাঁপিয়ে ভীষণ জোরে গর্জন করে উঠল, “বাঘু! বাঘুউউউউ! চালাকি হচ্ছে, চালাকি? কায়দাবাজি হচ্ছে, কায়দাবাজি? আমার হাত ছাড়, ছাড় বলছি।”
বাঘু ইয়েতির হাত ধরে এক টান দিল, “ছাড়িব না, ছাড়িব না। শুনিব না বাহানা।”
ইয়েতি বলল, “বাঘুউউউউ! আমার হাত ছাড়বি না কাতুকুতু দেব? আমাকে তোর ইয়েতি মনে হচ্ছে না? আমি ইয়েতি?”
বাঘু এক গাল হাসল, “চালাকি নেহি চলেগা, ইয়েতিদিদি। তুমি ইয়েতি নও তো কী, শিয়ালনী দিদিমণি?”
ইয়েতি দাঁত ছরকুটে হাসল, “ইয়েস, আমি শিয়ালনী।”
দেখতে দেখতে ইয়েতির মুখ সত্যিই শিয়ালনীর মতো হয়ে গেল আর বাঘু চোখ খুলে দেখল, সামনে সত্যিই দাঁড়িয়ে আছে শিয়ালনী দিদিমণি। ত্রিসীমানায় কোথাও কোন ইয়েতি নেই। সামনের গাছের ডাল বেয়ে গুটিগুটি নেমে আসছে হিনিমিনি। শিয়ালনী এদিকে কপাল চাপড়াচ্ছে, “হায় হায় হায়! এগুলোকে ঘুমোতে দিয়েও আমার শান্তি নেই। কেউ ঘুমের ঘোরে পুতুল ভেবে গাল টেপে, কেউ ইয়েতি ভেবে হাত ধরে টানে! ও হো হো হো!”
হাতুশি এগিয়ে এল তাই শুনে, “দিদিমণি, আমি কিন্তু কিছুই করিনি, বলুন? আমি কিন্তু আপনাকে একটুও জ্বালাইনি।”
শিয়ালনী চোখ গোলগোল করল, “তুই? তুই আর বলিস না? যা নাক ডাকছিলি আর লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ছিলি, যেন ঝড় বইছে আর মেঘ ডাকছে! তুই আর বলিসনি।”
হাতুশি শুঁড়খানাকে কাঁধে নিয়ে বলল, “তাও তো দিদিমণি, আপনি আমার বাবার ঘুম দেখেননি। আমার বাবা এমন জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে যে আমি একদিন একটা অশ্বত্থগাছের মাথায় উঠে গিয়েছিলাম। আর নাকডাকা? আপনাকে বরং আমি একদিন নিয়ে নিয়ে শোনাব।”
শিয়ালনী আঁতকে উঠে বলল, “থাক, আর অত উপকার না করলেও হবে, হাতুশি।”
হাতুশি বেচারি মুখ শুকনো করে বসে পড়ল। শিয়ালনী এবার হাঁক দিল, “যা, আজকের মত ছুটি। কাল টিফিনের পর তোদের সবাইকে আজ যা পড়ালাম, তার থেকে লিখতে দেব। নম্বর দিতেও পারি, নাও পারি।”
ব্যস, সবাই মিলে পোঁটলাপুঁটলি গুছিয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি চলল।
পরের দিন টিফিন শেষে ক্লাস শুরু হয়েছে। দিদিমণি লিখতে দেবেন, তাই গুছিয়ে বসেছে সকলে। সকলে মানে একজন বাদে। শিয়ালনী এদিক ওদিক তাকিয়ে শুধোল, “হ্যাঁ রে, বাঘু কোথায়? দেখছি না যে।”
হাতুশি শুঁড় উঁচিয়ে ধরল, “দিদিমণি, ও আমাদের সঙ্গে বসেই টিফিন খেল। তারপর আমরা আজ ইয়েতি- ইয়েতি খেলছিলাম, আমাদের সঙ্গে খেলছিলও। তারপর ঘণ্টা পড়তে আমরা তাড়াতাড়ি করে চলে এলাম, ওকে আর খেয়াল করিনি।”
শিয়ালনী বলল, “ও আচ্ছা। ঠিক আছে, আমি বোর্ডে প্রশ্ন লিখছি। তোরা প্রশ্নগুলো টুকে নে। তা করতে করতে নিশ্চয়ই চলে আসবে।”
দিদিমণি বোর্ডে প্রশ্ন দিতে শুরু করলেন-
১। যে বিখ্যাত বিজ্ঞানীজন্তু ইয়েতির চাঁটি খেয়েছিলেন, তাঁর নাম কী?
২। ইয়েতির একটি প্রতিশব্দ লেখ।
৩। বিখ্যাত বিজ্ঞানী কী ওষুধ বের করার পরীক্ষা করছিলেন?
৪। দুটি করে লেজ থাকলে জানোয়ারদের কী কী সুবিধা এবং কী কী অসুবিধা হতে পারত বলে তোমার ধারণা? নিজের ভাষায় লেখ।
দিদিমণির প্রশ্ন লেখা শেষ, কিন্তু তখনও বাঘু এসে পৌঁছল না। অনেকক্ষণ কেটে গেছে ততক্ষণে। সবাই পড়েছে চিন্তায়। শিয়ালনীর গলায় উদ্বেগের সুর, “হ্যাঁ রে, বাঘুর কোন আপদবিপদ হল না তো?”
শুনে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। ভালকি উঠে দাঁড়াল, “দিদিমণি, বাঘু একবার আমাকে বলছিল যে ওর মোটে পড়া হয়নি। আমার পড়া হয়েছে কিনা জিজ্ঞেস করছিল।
শুনে শিয়ালনী ঝাঁঝিয়েই উঠল, “বাঘু কবে পড়া করে বল্ তো? প্রতিদিনই প্রায় না পড়েই পরীক্ষা দেয়। তাহলে?”
হিনিমিনি লেজ নাড়াল, “দিদিমণি, আমি একবার চারপাশটা খুঁজে আসব?”
দোনোমোনো করে সায় দিল শিয়ালনী, “আচ্ছা বেশ, তাই যা। তবে বেশি দূরে যাস না। আর বাঘুকে পেলে সঙ্গে সঙ্গেই ওকে নিয়ে চলে আসবি।”
হিনিমিনি বেরিয়ে গেল। শিয়ালনী সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তোরা বরং ততক্ষণ যার যতটা টোকা বাকি আছে প্রশ্নগুলো টুকে নিয়ে উত্তর করতে শুরু কর।”
ওরা যে যার কাজ করতে আরম্ভ করল। খানিক বাদে ফিরে এল হিনিমিনি। একাই। শিয়ালনীর মুখ ঝুলে পড়ল, “কী রে, বাঘুকে পেলি না?”
হিনিমিনির করুণ মুখে জবাব দিল, “না দিদিমণি, এপাশ ওপাশ চারপাশই দেখে লাম। কোথাও দেখতে পেলাম না।”
শুনেই একটা হইচই বেধে গেল। উত্তর লেখা উঠল মাথায়। ঠিক হল, সবাই মিলে খুঁজতে বেরোবে। তা ছাড়া কোন উপায়ও নেই। হাতুশি ভাবনার সুরে বলল, “কিন্তু দিদিমণি, আমরা সবাই বেরিয়ে গেলে তারপর যদি বাঘু ফিরে আসে!”
শিয়ালনী চশমা খুলে চোখ মুছে বলল, “ঠিকই বলেছিস। সবাই মিলে বেরোনোটা ঠিক হবে না। পাঠশালা এরকমভাবে ফেলে যাওয়া ঠিক নয়। ঠিক আছে। হাতুশি, তুইই বরং এদিকটা সামলা। আমরা সবাই খুঁজতে বেরোই। আর বাঘু ফিরে এলে তখন তোর ওই বৃংহণ মানে হাতির ডাক ডেকে জানাস।”
হাতুশিকে পাঠশালায় রেখে ওরা সকলে খুঁজতে বেরোল। কাছেপিঠে যত গাছ আছে হিনিমিনি আরেকবার ভালো করে খুঁজল। পাঠশালার সামনের মাঠের চারপাশ, একটু দূরের বুড়ো বটগাছের আশপাশ- সব খোঁজা হল তন্ন তন্ন করে। কিন্তু কোথাও বাঘুকে পাওয়া গেল না। ওদের সবারই চোখমুখ শুকিয়ে ছোট হয়ে গেছে। শিয়ালনীর মনের মধ্যেও চোরা আতঙ্কের হিমশীতল স্রোত নামছে তিরতির করে। বাঘুকে না পাওয়া গেলে কী হবে?
ভালকিকে থাবাছানি (হাতছানির মতন আর কী!) দিয়ে ডাকল শিয়ালনী, “ভালকি, তোরা বরং চারিদিকটা আরও যতটা পারিস ভালো করে খোঁজ। আমি বরঞ্চ একটু দূরের দিকে খুঁজতে যাচ্ছি। বাঘুকে পেলে তোরা অপেক্ষা করিস। আমি খোঁজাখুঁজি করে ফিরে আসছি।
বাঘুর সন্ধানে ভালকি, কুমরু আর হিনিমিনি একরকম তোলপাড় করে ফেলল চতুর্দিক। কিন্তু তবু বাঘুর দেখা আর মিলল না।
এদিকে হাতুশি একা পাঠশালায় বসে বসে চারিদিকে নজর করছিল। এদিক ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নিজের বইখাতা সব গুছিয়ে রাখল। বোর্ডের প্রশ্নগুলো টোকা কিছু বাকি ছিল, সেগুলো শেষ করল। তারপর বসে বসে আকাশপাতাল ভাবতে থাকল।
বসে বসে একটু ঝিমুনিমতও এসে গিয়েছিল হাতুশির, এমন সময় কী একটা শব্দে চমকে গিয়ে ঝিমুনিটা কেটে গেল তার। তাকিয়ে দেখে, সেগুনগাছের একটা ডাল ভেঙে সামনে পড়েছে। আকাশের দিকে চাইল সে। বেলা পড়ে এসেছে। আকাশের সূর্যস্যারের বিশ্রামের সময় হয়ে গেছে। অন্যদিন এইসময় পাঠশালা ছুটির সময় হয়ে যায়। ভাবতে না ভাবতেই মনটা খারাপ হয়ে গেল তার। কী যে হবে? বাঘুটাকে নিশ্চয় এখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। তাহলে সবাই ফিরে চলে আসত।
ভাবতে ভাবতেই আনমনে পাঠশালার বাইরে এসে পায়চারি শুরু করল হাতুশি। হঠাৎ করে তার মনে হল, কাছাকাছি কোন জায়গা থেকে খুব মৃদু একটা ঘুঁ- ঘুঁ আওয়াজ আসছে না? শব্দের উৎস অনুসরণ করে সেদিকে এগোতে থাকল সে।
শিয়ালনী এদিকে বনের মধ্যে অনেকদূর চলে গেছে বাঘুকে খুঁজতে খুঁজতে। খরগোশ ডাক্তারদিদি স্টেথোস্কোপ গলায় বিকেলের রুগী দেখতে বেরিয়েছেন। তাঁকে জিজ্ঞেস করেও বাঘুর কোন হদিশ পাওয়া গেল না। যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকেই জিজ্ঞেস করে। কিন্তু বাঘুর খোঁজ আর কেউ দিতে পারে না। চারপাশের বনজঙ্গল, ঝোপঝারের মধ্যে বিস্তর তল্লাশি চালিয়েও বাঘুকে কোথাও খোঁজ মিলল না। বুকের ভেতর ধুকধুক করছে শিয়ালনীর। মায়েরা বাবারা কত ভরসা করে তার কাছে পড়তে পাঠিয়েছে, এবারে পাঠশালা থেকে যদি বেমালুম বাচ্চা উধাও হয়ে যায়, তাহলে? মুখ দেখানোর জায়গা থাকবে?
বেলা গড়িয়ে এসেছে। পাঠশালা ছুটির সময় হয়ে গেছে। বাকি পশুয়ারাও সে না ফিরলে বাড়ি যেতে পারবে না। সাতপাঁচ ভেবে যেই না ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে শিয়ালনী, অমনি দূর থেকে ভেসে এল হাতুশির ঘন ঘন ডাক, যাকে বলে বৃংহণ। প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসেই এবার পাঠশালার পথ ধরল শিয়ালনী।
পাঠশালার কাছাকাছি পৌঁছে শিয়ালনী অবাক। এ কী! পাঠশালা যে বেবাক ফাঁকা! কেউ নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে যখন, ঠিক তখনই হাতুশির গলার ডাক ফের শোনা গেল। অন্য কোথাও থেকে নয়, ডাকটা এল শিয়ালনীর নিজের ঝোপ থেকে।
চটপট করে নিজের ঝোপে পোঁছেই শিয়ালনী অবাক। একটা বালিশ বিছানা একপাশে রাখাই থাকে। কেউ যদি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে, সে কথা ভেবে। তার উপর আরাম করে শুয়ে ঘুমোচ্ছে বাঘু, আর ঘুঁ ঘুঁ করে নাক ডাকছে। হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু সবাই সামনে দাঁড়িয়ে। হাতুশির এত প্রবল ডাকেও তার ঘুম ভাঙেনি।
সবাই মিলে ঠেলাঠেলি করে বাঘুকে তোলা হল। ঘুম ভেঙেই বাঘুর একগাল হাসি, “ইসসস, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, না? দিদিমণি,একটা কী যেন পরীক্ষা ছিল না? দিদিমণি, আপনি প্রশ্ন দিয়ে দিন, উত্তরগুলো লিখে দিয়ে বাড়ি চলে যাই।”
শিয়ালনী ফেটে পড়ল রাগে, “অ্যাঁ, আমাদের সারা বনজঙ্গল ছুটিয়ে মেরে পড়াশুনো পণ্ড করে এখন ঢং হচ্ছে, না? এখানে এসে আরাম করে শোয়ার বেলায় কিছু মনে ছিল না, না? টিফিনের পর তুই এমনি এমনি আমার ঝোপে এসে গেলি, না? তোর চালাকি আমি বুঝি না ভেবেছিস? চল্, তোর সঙ্গে আমি এখন তোর বাড়ি যাব। তোর মাকে সবকথা বলব। তারপর তোর বাড়িতেই আজ তোকে সারা সন্ধে পড়াব। দরকার হলে রাতেও থেকে যেতে পারি।”
আর বাঘু? এত ভালো ঘুমের পর এমন ঘোরতর বিপর্যয়ে রীতিমতো দিশেহারাই হয়ে পড়ল সে, “হায় হায় হায় হায়! এ আমার কী হল ভাই… ছুটির পরও একটু শান্তি নাই… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… দিদিমণি বাড়ি গিয়ে করাবে পড়াশুনা… না পড়লে করবে তুলোধোনা… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… যত হাসি তত কান্না… এই আমি বলছি বাঘু শর্মা… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ।”
অংকনঃ গুঞ্জা
………০………
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়ুন নিচের লিঙ্কে ক্লিক করেঃ-