(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)
ঠাণ্ডাটা পড়েছে জব্বর। উত্তুরে হাওয়ায় বনের গাছপালাগুলো অব্দি কাঁপছে হি হি করে। গ্রীষ্মকালে পাউডার মাখতে পায় না বলেই বোধহয় শীতকালে সারা গায়ে পাউডারের মতন ইচ্ছেমতন কুয়াশা মেখেছে যত গাছগাছালি। আকাশে যে রাগী সূর্যস্যার থাকেন, তিনি এসব পাউডার মাখা পছন্দ করেন না মোটে। তাঁর তেজের সামনে অন্যদিন কুয়াশারা পালাতে পথ পায় না। কিন্তু হলে কী হবে, আজ এত বেলা অব্দি তাঁর দেখা নেই। মনে হয় সেই যে রাতে লেপমুড়ি দিয়ে ঘুমোতে গেছেন, এখনো তাঁর ঘুম ভাঙেনি।
ভালকি পাঠশালায় এসে একটা গাছের ডাল দিয়ে ঘর কেটে একা একাই কিতকিত খেলছিল। বন্ধুদের কারুরই দেখা নেই এখনো অব্দি। এমনকি, দিদিমণি পর্যন্ত আসেনি। আপনমনে খেলছে ভালকি, এমন সময় বাঘু এসেই হাতের থলেখানাকে দমাস করে ছুঁড়ে ফেলেই থাবা জড়ো করে মাথা ঝাঁকাতে শুরু করল, “ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু!”
ভালকি খেলা থামিয়ে অবাক চোখে তাকাল, “কী বলছিস রে, বাঘু?”
বাঘু আরেক দফা থাবা কাঁপিয়ে জবাব দিল, “বলছি যে, ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু!”
ভালকি ফিকফিক করে হেসে বলল, “ঠাণ্ডু আবার কী জিনিস রে, বাঘু?”
বাঘু বেজায় গম্ভীর চালে উত্তর দিল, “ঠাণ্ডু জানিস না? বেশি ঠাণ্ডাকে বলে ঠাণ্ডু। তখন কাঁপতে হয় এইরকম করে! ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু! আর কম ঠাণ্ডাকে বলে ঠাণ্ডি। তখন কাঁপতে হয় এইরকম করে। ঠাণ্ডি-হি-হি-হি-হি-হি।”
শুনেই শুঁড় কাঁপিয়ে হাতুশির সে কী হাসি! হাতুশি যে ওদের কথার মাঝে কখন এসে গেছে ওরা কেউ খেয়ালই করেনি। বাঘু চোখ সরু করে তাকাল হাতুশির দিকে, “কী ব্যাপার? তুই হাসছিস যে বড়?”
হাতুশি বলল, “হাসব না? কী কথাই না শোনালি রে তুই, বাঘু? ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু-হু! ঠাণ্ডি-হিহি-হিহি হি!”
হাতুশির হিহিহিহি শুনে পাঠশালায় সদ্য ঢোকা হিনিমিনি আর কুমরুও হাসতে শুরু করে দিল কিচ্ছুটি না শুনেই।
বাঘুর ভয়ানক রাগ হল। থাবাটাবা ছুঁড়ে বিকট জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “যা যা! তোদের আর কোন ভালো কথা বলবোই না। ঠাণ্ডায় কাঁপতে হয়, আমি একাই কাঁপবো। ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু! ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু! ঠাণ্ডু-হু-হু-হু-হু!”
গোলমাল ভালোই পাকিয়ে উঠেছে, এমন সময় পিছনে শিয়ালনীর গলা পাওয়া গেল, “কী ব্যাপার রে, সব? সক্কালবেলাতেই এত গোলযোগ কিসের? চল্, চল্- প্রার্থনার লাইনে দাঁড়িয়ে পড় ঝটপট। আমি আসছি। উফফ! কি ঠাণ্ডা রে বাবা! হু হু হু হু!”
বলতে বলতেই শিয়ালনী ঢুকে গেল নিজের ঝোপে। ওরাও তাড়াতাড়ি করে দাঁড়িয়ে পড়ল প্রার্থনার লাইনে।
প্রার্থনার পরে ক্লাস শুরু হয়েছে। আজ সকলেরই পরনে কমবেশি শীতের পোশাক আশাক। অন্যসময় ওদের গরম লাগে বলে কাপড়চোপড় পরে না। হাতুশির গায়ে একটা জম্পেশ ব্যাগি সোয়েটার, তাতে আবার একটা কলাগাছের ছবি। হিনিমিনির পঞ্চোতে একছড়া কলার ছবি। ভালকির গায়ে একটা জ্যাকেট, সেটায় একটা বাচ্চা ভালুক আঙুলে মধু চুষছে। কুমরু পরে এসেছে একটা মাছের ছবিওলা গলাবন্ধ কোট। এমনকি দিদিমণি অব্দি গায়ে একটা আঙুরফলের ছবি আঁকা উলের চাদর চাপিয়ে এসেছেন। আর সেখানে বাঘু? বাঘু সেই ‘জান্তা জটে’র দেওয়া লেজস্ত্রাণ আর থাবাস্তানা পরে এসেছে খালি, আর সারা গায়ে সোয়েটার ফোয়েটার কিচ্ছুটি নেই।
শিয়ালনী সেদিকে তাকিয়ে ভুরু টুরু বেজায় কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার রে, বাঘু? এত ঠাণ্ডা পড়েছে আর তুই গায়ে গরম কিছু দিসনি যে বড়?”
বাঘু বলল, “দিদিমণি, গায়ে গরম কিছু দিলে তো গরম লাগবে। তাতে যদি আবার শীতকাল চটে যায়! শীতেরও তো একটা মান সম্মানের ব্যাপার আছে! তাই না, দিদিমণি?”
শিয়ালনী দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “শীতের মান সম্মান নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না, বাঘু বাছাধন! কাল থেকে সোয়েটার পরে আসবে। বুঝেছ?”
বাঘু ভারি অবাক হয়ে শুধোল, “গরম পড়ে গেলেও সোয়েটার পরে আসবো, দিদিমণি?”
ভয়ানক চটে গেল শিয়ালনী, “তোকে আমি তাই বলেছি, বাঘু? গরম পড়লে সোয়েটার পরা যায়? এমনিতেই বছরে অন্য সময় জামাকাপড় আমরা কেউ পরি না গরমের চোটে, আর সোয়েটার?”
ভালকি বেশ বিজ্ঞের ভঙ্গিতে বলল, “জামাকাপড় মানুষেরা পরে। আমরা ওসব পরি টরি না।”
হিনিমিনি সায় দিল, “ওই শীতের সময়টাই যা।”
হাতুশি দেখে, এসব কথাবার্তায় পড়াশুনোটাই মাটি হয়ে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “দিদিমণি, আজ পড়াবেন না?”
শিয়ালনী হঠাৎ করে কিরকম যেন চমকে উঠে বলল, “হ্যাঁ, তাই তো। পড়াবো তো বটেই। এই বাঘুর ঠ্যালায় সব গোলমাল হয়ে গেল।”
একথায় বাঘু সটান উঠে গিয়ে সোজা দিদিমণির গলা জড়িয়ে ধরল, “ও আমার পাবতু পুবতু দিদিমণি গোওওও! আপনি আমায় সকাল থেকে সমানে বকছেন গোওওও! আমার খুব মন খারাপ করছে গোওওও। আমি এখন আপনাকে জড়িয়ে ধরে একটু কাঁদি গোওওওও!”
কুমরু এতক্ষণ চুপচাপ বসে সব দেখছিল। এবার সোজা গিয়ে বাঘুর লেজস্ত্রাণ ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বলল, “বেশি কায়দাবাজি করলে এবারে আপনি এক থাবড়া খাবেন গোওওও! ক্লাস পণ্ড করার মতলব করলে পিটুনিটিও খেতে পারেন গোওওও! আপনার বাঘিপিসীকেও খবর দেওয়া হতে পারে গোওওও!”
বেচারি বাঘু নিজের জায়গায় গিয়ে বসে পড়ল বটে, কিন্তু সমানে গজগজ করতেই থাকল, “একটু মনের সুখে কাঁদতেও পারি না! এমন একখানা পাঠশালা জুটেছে কপালে! ঠাণ্ডায় কাঁপা যদি নাই যায়, তাহলে ঠাণ্ডা আছে কী করতে?”
হাতুশি এদিকে বই নিয়ে গেছে শিয়ালনীর কাছে, “দিদিমণি, আজ এই রচনাটা পড়ানোর কথা ছিল। এই যে, শীতকাল।”
শিয়ালনী চশমাটা চোখে ভালো করে এঁটে নিয়ে গলা ঝাড়ল, “হুমম। হামম। শীতকাল? আচ্ছা, বেশ। তোরা সবাই একে একে রিডিং পড়বি প্রথমে। বাঘুউউউ, তুই-ই আয় প্রথমে। ‘বন বাংলা’ বইটা নিয়ে আয়। ‘শীতকাল’ খোল।”
অমনি লাফিয়ে উঠল বাঘু, “দিদিমণি, শীতকাল খুলবো কী করে? শীতকাল কি আর একটা খোলার মতন জিনিস হল? শীতকাল কি সোয়েটার না জামা?”
ভীষণ বিরক্ত হল শিয়ালনী, “উফফফ! এটাকে নিয়ে আর পারা গেল না! হতভাগা, তোকে কি আমি তাই বলেছি? তোকে আমি বললাম, ‘বন বাংলা’ বইয়ে যে ‘শীতকাল’ বলে রচনাটা আছে, সেইটার পাতা খুলতে। এইবারে বুঝলি?”
পেঁয়াজের খোসা খেয়ে ফেলার মতো মুখ করে বাঘু বলল, “বুঝলাম। তবে ভালো বুঝলাম না। এইটুকুনি বুঝলাম যে আমিই চিরকাল বকুনি খাই আর খাবো।”
ভয়ংকর ক্ষেপে গেল শিয়ালনী, “বাঘুউউ! বাঘুউউউউ! পড়া শুরু কর। শীতকাল। নো চালাকি, নো কায়দাবাজি!”
বাঘু খানিক নাক চুলকোল, খানিক কান চুলকোল, খানিক লেজ চুলকোল। তারপর পড়া শুরু করল,- “শীতকাল। পৌষ ও মাঘ- এই দুই মাস শীতকাল। শীতকাল খুব শীতল। বনের জন্তু জানোয়ারেরা ঠাণ্ডায় কাবু হয়ে যায়। শনশন করে উত্তুরে হাওয়া বয়। গাছেদের পাতা ঝরে যায়। এমনকি, যেসব পশুরা সারাবছর জামাকাপড় পরে না, তারাও এইসময় অনেকেই গায়ে গরম কিছু দেয়। এছাড়াও শীতকালে ‘জন্তু জলসা’, ‘পশু পার্বণ’ ইত্যাদির আয়োজন করা হয়। পিঠেপুলি, নলেন গুড়ের পায়েস, ফুলকপির পরোটা, মটরশুঁটির কচুরি ইত্যাদি ইত্যাদি ভালো ভালো খাবার খেয়ে পুলকিত হয় সকল জানোয়ার। শীতকালের রোদও বেশ মিঠেপাক সন্দেশের মতন। শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে ভালো ভালো খাবার খাওয়া কি গল্পের বই পড়ার মজাই আলাদা। অনেকে অবশ্য শুধুশুধুই রোদ পোহায়।
শীতকালে বৃষ্টি বিশেষ হয় না। আবহাওয়া শুকনো থাকে। রোদের তেজ কম থাকে বলে ঘামও খুব একটা হয় না। তার জন্য শীতকালে অনেকেই চড়ুইভাতি করে। চড়ুইভাতির আরেক নাম ‘বনভোজন’। বনভোজনে দারুণ দারুণ খাওয়া দাওয়া হয়। দেদার মজা হয়। …”
হঠাৎ হাঁউমাঁউ করে চেঁচিয়ে উঠল বাঘু, “দিদিমণি, এইটা কিরকম হল? বনভোজনে যেতে না পারলে কী করে বুঝবো যে বনভোজনে মজা হয় না কান্না পায়? আর বুঝতে না পারলে রচনাই বা লিখি কী করে? আপনিই তো বলেন না বুঝে পড়া মুখস্থ করতে নেই।”
বাঘুর কথা শেষ হতে না হতেই দু’ফোঁটা চোখের জল মুছল কুমরু, “হ্যাঁ, দিদিমণি। শীতকালে আমাদের পাঠশালার কোন বনভোজন হবে না, এটা ভাবতেই কিরকম লজ্জা লাগছে, দিদিমণি!”
ভালকি গালে থাবা দিয়ে দুখী দুখী মুখে বলল, “বনে থেকেও যদি বনভোজন না হয়, সে তো বেজায় বেদনার বিষয়!”
হিনিমিনি তুড়ুক তাঁই করে একখানা লাফ দিয়ে এসে বসল শিয়ালনীর সামনে, “দিদিমণি, বনভোজনে যেতে হয়, নইলে পিছিয়ে পড়তে হয়।”
হাতুশি উঠে দাঁড়িয়ে থাবাজোড় করল, “হ্যাঁ, দিদিমণি। শীতকালে বনভোজন না হওয়া মানে যেন বালিশ ছাড়া বিছানা, যেন নুন ছাড়া ঘুগনি, যেন চিনি ছাড়া রসগোল্লা, যেন ঘুঙুর ছাড়া নাচ, যেন লেজ ছাড়া জানোয়ার, যেন…”
শুনেই কিরকম যেন খেপে গেল শিয়ালনী, “যেন লেখাপড়া ছাড়া পাঠশালা! সকাল থেকে পড়ার নাম নেই, খালি এইসব উষ্টুম ধুষ্টুম করে যাচ্ছে তো করেই যাচ্ছে! পাঠশালা না গোশালা?”
কাঁচুমাঁচু মুখে উঠে দাঁড়াল বাঘু, “ও দিদিমণি, দিদিমণি গো! আমাদের বনভোজনে নিয়ে চলুন গোওওও! নাহলে আমি এবারে কেঁদে ফেলব গোওওও! তখন কী ভালো হবে গোওওও! আমি কাঁদতে শুরু করলে ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে যাবে গোওওও!”
শিয়ালনীর লেজখানা রাগে নাগরদোলার মতন পাঁইপাঁই করে ঘুরছে, “থামবি সব? তখন থেকে ঘ্যানঘ্যান করে কানের পোকা বের করে দিল একেবারে! বাঘু বাছাধন! তোমায় আর কাঁদতে হবে না গোওওওও! বনভোজনে নিয়ে যাবো গোওওও! কিন্তু পড়া ঠিকঠাক না করলে কানে অ্যাইসান জিলিপির প্যাঁচ পড়বে গোওওও! তখন এমনিতেই কাঁদতে হবে গোওওওও!”
বাঘু ফিক করে হাসল, “ওঁ বনভোজনায় নমঃ! ওঁ আনন্দ ফূর্তিং স্বাহা!”
হাতুশি শুঁড় দোলাল, “দিদিমণির এই পাঠশালায়, চড়ুইভাতি ছাড়া কি মানায়?”
হিনিমিনি লেজ ঝাঁকাল, “দিদিমণি বেজায় ভালো, বনভোজনে জলদি চলো।”
এতই রেগে গেছে শিয়ালনী যে রাগে তার লেজ ধাঁইধাঁই করে ঘুরছে, কানের ভেতর সাঁইসাঁই আওয়াজ হচ্ছে, নাকের ভেতর ফাঁইফাঁই শব্দ হচ্ছে, পেট আইঢাই করছে। কোনমতে সেসব সামলে সুমলে ঘোরতর হাঁক ছাড়ল শিয়ালনী, “কী ভেবেছিস কী সব? আমি কিছু বলি না বলে তোরা যা খুশি তাই বলে যাবি? কান খুলে শুনে রাখ, বনভোজন নিয়ে একটাও কথা নয় এখন। যা কথা হবার, টিফিনের পরের একদম শেষের ক্লাসে আলোচনা হবে। নইলে কিন্তু বনভোজন টনভোজন সব বিলকুল বন্ধ। বুঝলি? এখন সবাই ‘শীতকাল’ রচনা মুখস্থ করবি আর খাতায় লিখবি। নো কথা, নো বার্তা!”
ব্যস, অত গোলমাল নিমেষে গায়েব। সক্কলে চুপ। মাথা ঝুঁকে প্রাণপণে পড়ছে সবাই। এমনকি, বাঘুও।
টিফিন অব্দি কাটলো ভালোয় ভালোয়। টিফিনের সময় ওরা নিজেদের মধ্যে বনভোজন-বনভোজন খেলল মহা ফূর্তি ভরে। টিফিন শেষের ঘন্টা পড়তেই শুরু হয়ে গেল হইচই। শিয়ালনী ক্লাসে ঢুকতেই সকলে মিলে উঠে দাঁড়িয়ে থাবাজোড় করে একসুরে বলল, “দিদিমণি নমস্কার/ বনভোজনের বিশেষ দরকার।”
শিয়ালনী রাগল না। নরম সুরেই বলল, “বোস সবাই। বনভোজনের জন্য মন ছটফট করছে, না? ঠিক আছে। শোন্। আজ তো শুক্রবার। আগামী পরশু দিন রবিবার। ঐদিনই সকাল সাতটায় এখান থেকে বেরোবো। এই জঙ্গলের পরের জঙ্গলেই ঝালুমালু বলে একটা জায়গা আছে। ঘন বনের মাঝে সুন্দর একটা নদী। বয়ে যাচ্ছে তিরতির করে। টলটলে নীল জল। ওখানেই যাবো আমরা। জায়গাটার পাশেই নানা ধরনের সবজির খেত। ওদিকের জানোয়ারেরা সারা বছর চাষবাস করে। শাকসবজি ওখানের ক্ষেত থেকে নিয়ে নিলেই হবে। আমরা তো আর মানুষের মতো নই যে এর ক্ষেতের আনাজ নেওয়া যাবে না, ওর গাছের ফল নেওয়া যাবে না। তবে তোদের এক এক জনকে একেক রকম জিনিস আনার দায়িত্ব নিতে হবে। ধর, কেউ আনলি শালপাতার থালা বাটি গেলাস, কেউ আনলি শেষপাতের মিষ্টি, সকালের টিফিনের ব্যবস্থা হয়তো ভাগাভাগি করে আনলি দু’জন। তারপর রান্নার বাসনকোসনও আনার আছে। বাকি যা থাকে সব আমি নিয়ে আসবো। আর দুপুরের রান্নাটা আমিই করবো। তোরা আমাকে সাহায্য করবি।”
অমনি লেজ চুলকোতে চুলকোতে উঠে দাঁড়াল বাঘু, “দিদিমণি, মাংস রান্নার সাহায্যটা আমিই করবো।”
দু’ চোখ পাকিয়ে পেল্লায় এক ধমক দিল শিয়ালনী, “তোমার মতলব আমি বুঝি না, বাঘু বাছাধন? ওসব কায়দাবাজি ছাড়। সাহায্য করার নামে ভরপেট সাঁটাবি তুই। চালাকি পায়া হ্যায়?”
গোঁজ হয়ে বসে পড়ল বাঘু, “ঠিক আছে, দিদিমণি। কায়দাবাজি ছেড়ে দিলাম। চালাকি একটু একটু পাচ্ছিল আগে, এখন আর পাচ্ছে না।”
শিয়ালনী ভুরু কুঁচকে ধনুকের মত হয়ে গেল, “হাতুশি! তুই তৈরি থাকবি। বাঘু যদি এরপরে আবার ফ্যাকড়া বাধায়, তাহলে ওকে শুঁড়ে করে পিঠে তুলে পাঁইপাঁই করে দু’পাক ঘুরে আসবি মাঠ থেকে।”
শুনেই বাঘু জড়োসড়ো হয়ে বসল। হাতুশির পিঠে চাপাকে সে রীতিমতো ভয় পায়। শিয়ালনী এদিকে আবার বলতে শুরু করেছে, “অবশ্য হাতুশি, হিনিমিনি এমনিতেই মাংস খায় না। ওদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। বেশ, এবার তাহলে তোরা বল্, ওইদিন কে কী নিয়ে আসবি।”
হিনিমিনি মাথার উপরে হাত তুলে চেঁচিয়ে উঠল, “দিদিমণি, আমি কলা নিয়ে আসবো। বেশ পুরুষ্টু পুরুষ্টু মর্তমান কলা।”
কুমরু তার থাবা দিয়ে মাথাটা খানিক চুলকে নিয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি বরং আমাদের নদী থেকে কিছু টাটকা মাছ নিয়ে আসবো।”
ভালকি মাথাটাকে এদিক ওদিক দুলিয়ে বলল, “দিদিমণি, আমার বাবা তো ভালো রান্না করতে পারে। এই তো, কয়েকদিন আগেই ‘ভালুক পাচকরত্ন’ উপাধি পেল। আমি বাবাকে বলবো, বাবা নলেন গুড়ের রসগোল্লা আর মটরশুঁটির কচুরি বানিয়ে দেবে সকালের জন্য।”
হিনিমিনি বলল, “আর তার সঙ্গে আমার কলা তো রইলোই। বেশ জমজমাট প্রাতঃভোজন হবে।”
শিয়ালনী চিন্তার সুরে বলল, “সে নাহয় হল। কিন্তু… তবুও… আচ্ছা… বরং…।”
হাতুশি শুঁড়খানাকে বেশ গম্ভীর গম্ভীর করে শুধোল, “দিদিমণি, ‘কিন্তু তবুও আচ্ছা বরং’ মানে কী?”
শিয়ালনী ঘাড় নাড়ল, “ও কিছু না। একটা জিনিস ভাবছি। দাঁড়া, এভাবে হবে না। হাতুশি, তুই একটা চক শুঁড়ে নে। তারপর বোর্ডের কাছে যা। আমি যেমন যেমন বলছি, তেমন তেমন লিখবি। অবশ্য তোরাও মতামত দিবি। ভোজনের একটা তালিকা তৈরি করা যাক।”
বেশ খানিকক্ষণ আলাপ আলোচনার পর হাতুশি বোর্ডে যা যা লিখল সেটা এরকমঃ
বনভোজনের ভোজন তালিকাঃ-
প্রত্যূষের আহার
১। মটরশুঁটির কচুরি
২। আলুর দম
৩। নলেন গুড়ের রসগোল্লা
৪। পুরুষ্টু মর্তমান কলা
মধ্যাহ্নভোজের ফিরিস্তি
১। বাসমতী চালের ভাত (হাতুশির খোরাক কিঞ্চিৎ বেশিই)
২। লেবু (যে যত খুশি নিতে পারে। দাঁত না টকিয়া যাইলেই হইল)
২। ঝিরিঝিরি আলুভাজা (আলু কাটার দায়িত্ব হিনিমিনির)
৩। বেগুনভাজা (ভালকি কাটিবে এবং নুন- হলুদ মাখাইবে)
৪। বিবিধ সবজি সহযোগে ডাল (দিদিমণি রাঁধিবেন। বাঘু সাহায্য করিবে।)
৪। আলু- ফুলকপির তরকারি (খেতের টাটকা আলু ফুলকপি লইলেই চলিবে।)
৫। মাংসের ঝোল (বাঘু হইতে সাবধান)
৬। ইঁচড়ের তরকারি (হাতুশি- হিনিমিনির জন্য বরাদ্দ।)
৭। মাছের ধুন্ধুমার (রন্ধনপ্রণালী কুমরুর নিজস্ব। দিদিমণি কুমরুর কথামত রাঁধিবেন।)
৮। কাঁচকলার কোপ্তা (হাতুশি-হিনিমিনির জন্য। হিনিমিনি ব্যবস্থাপনা করিবে।)
৯। চাটনি (উপকরণ কুমরু আনিবে)
১০। পাঁপড়ভাজা (সম্পূর্ণরূপে দিদিমণির দায়িত্ব)
১১। রাবড়ি (হাতুশি আনিবে)
লেখা শেষ হতেই শিয়ালনী মাথা দুলিয়ে বলল, “এই তো। একদম ঠিকঠাক। হিনিমিনি, তুই যেটা টুকলি- সেটা আমায় দে। আমি এই দেখে বাকি ব্যবস্থা করবো।”
বলতে বলতেই শিয়ালনীর নজর গেছে বাঘুর দিকে। সে তখন দুলে দুলে মুখস্থ করছে, “…বেগুনভাজা ভালকি কাটিবে এবং নুন- হলুদ মাখাইবে……এঁ এঁ এঁ…বিবিধ সবজি সহযোগে ডাল…এঁ এঁ এঁ…দিদিমণি রাঁধিবেন, বাঘু সাহায্য করিবে…এঁ এঁ এঁ…আলু-ফুলকপির তরকারি…এঁ এঁ এঁ…আলু-ফুলকপির তরকারি…”
শিয়ালনী হতভম্ব, “এ কী রে, বাঘু! এসব কী মুখস্থ করছিস?”
বাঘু থাবায় একটা পেনসিল নিয়ে ঘাড় নাড়তে নাড়তেই উঠে দাঁড়াল, “পড়া মুখস্থ করছি, দিদিমণি। যদি আপনি বনভোজনে গিয়ে আমাকে খাদ্যতালিকাটা মুখস্থ ধরেন… তাই আর কী!”
হাতুশি দেখল, বাঘুর এইসব কাণ্ডে পাছে যাওয়াটাই পণ্ড হয়ে যায়! তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “দিদিমণি, বাঘুর কথায় একদম কান দেবেন না। আমরা বরং এইবারে বাড়ি যাই? কাল গোছগাছ করে পরশু সকাল সকাল আসতে হবে।”
শিয়ালনী একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “তাই-ই আয়। পরশু ভালোয় ভালোয় বনভোজন শেষ হলে বাঁচি।”
তিড়িং করে একখানা লাফ মেরে রবিবার এসে গেল। একদম ভোরবেলাতেই পাঠশালা সরগরম। সব্বার পোঁটলা ভর্তি হরেক জিনিস, খাবারদাবার। লেজকাঁপানো ঠাণ্ডা! সবার পরনেই গরম পোশাক। খালি বাঘু পরে এসেছে একটা হাতকাটা গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। আর লেজস্ত্রাণ তো আছেই। ভালকিও তার লেজস্ত্রাণ পরে এসেছে আজ। শিয়ালনী তাড়া দিল, “চল্, চল্, আর দেরি করার দরকার নেই। জিনিসপত্র যা আছে, ভাগাভাগি করে নিয়ে নে। আমিও নিচ্ছি। হাতুশি, তুই বরং একটু বেশি জিনিসই নিস।”
বাঘু আবদারের সুরে বলল, “দিদিমণি, আমি প্রত্যূষ আহারের জিনিসগুলোই বয়ে নিয়ে যাই বরং।“
শিয়ালনী হাঁ হাঁ করে তেড়ে এল, “তুই বইলে ওই জিনিস আর ঝালুমালু পর্যন্ত পৌঁছোবে?”
বাঘুর চোখমুখ কাঁদোকাঁদো, “দিদিমণি, আপনি আমাকে একটুও বিশ্বাস করেন না। আমি জলখাবার সাবাড় করলে বকুন, তা না! আগেই বকছেন!”
বাঘুর এইসব কান্নাকাটিতে পাছে দেরি হয়ে যায়, তাই তড়িঘড়ি করে বলল শিয়ালনী, “ঠিকাছে। ঠিকাছে। আর মায়াকান্না কাঁদতে হবে না, বাঘুবাবু। চল্ সবাই, পা চালিয়ে। আয় আমার পিছু পিছু।”
হইচই করতে করতে চলল সবাই দিদিমণির পিছু পিছু। দিদিমণির ঠিক পিছনেই হাতুশি। বাকিরা তার পিছনে। হাতুশি একটা গান বানিয়েছে আগের রাতে। সে সুর করে সেই গানটাই জুড়ল-
ট্যাং ট্যা ট্যাটাং ট্যাং।
বনভোজনে যাবার নামে নাচি তুলে ঠ্যাং।
যাবো ঝালুমালু,
পৌঁছে গিয়ে খাবো সেথা দম দেওয়া আলু।
মটরশুঁটির কচুরি-
ভাবতে গেলেই প্রাণে লাগে খুশির ফুলঝুরি।
আহা, খুশির ফুলঝুরি…
মনে রঙের ঢেউ-
পশুয়াদের এমন মজা ভাবতে পারে কেউ?
চলেন বাঘুবাবু-
ভালোমন্দ খাবার পেলে বেজায় তিনি কাবু…
বাঘুর নামে ওদের সবারই টনক নড়ল। তাই তো, বাঘু কোথায়? অনেকটা পথ চলে এসেছে ওরা। শিয়ালনীও চলতে চলতে থমকেছে, “তাই তো রে, বাঘু কোথায়?”
‘বাঘু’, ‘বাঘুউউউউ’ করে বারকতক ডাকাডাকি হল জোরে জোরে। কোথাও কোন সাড়া নেই। সবার মুখচোখ শুকিয়ে এতটুকু। হিনিমিনিই শেষে গা ঝাড়া দিয়ে বলল, “দিদিমণি, আমি দেখে আসি।”, বলেই মর্তমান কলার পোঁটলাটা কাঁধে ফেলে পলকে হাওয়া।
বেশ খানিকক্ষণ কেটে গেল, কারুরই কোন পাত্তা নেই। না হিনিমিনি, না বাঘু।
কী হল? তাজ্জব ব্যাপার। কুমরু চোখের জল থাবায় মুছতে মুছতে বলল, “দিদিমণি, আমি বরং যাই। দেখে আসি, কী ব্যাপার।”, বলেই থপথপ করে পা ফেলতে ফেলতে নিমেষে উধাও।
আরও কিছুটা সময় কেটে গেল। বাঘু, হিনিমিনি, কুমরু- তিনজনেরই না কেউ এল, না কারুর সাড়াশব্দ পাওয়া গেল। ব্যাপারস্যাপার দেখে ভালকি বলল, “দিদিমণি, আমি বরং যাই। দেখে আসি।” বলতে না বলতেই গাছপালার আড়ালে ভালকিকে আর দেখা গেল না।
অপেক্ষা করে বসেই আছে হাতুশি আর শিয়ালনী। ভালকিও গেল যে গেল, সেই যে গেল, আর এল না। শেষকালে আর হাতুশি থাকতে না পেরে দিদিমণিকে বলল, “দিদিমণি, আমি এবার যাই। কী হালচাল দেখে আসি। এতটা সময় পেরিয়ে গেল, খুব চিন্তার কথা। আসি, দিদিমণি।”
শিয়ালনী কোন কথা বলারই সুযোগ পেল না। এক লহমার মধ্যে হাতুশিও অদৃশ্য। শিয়ালনী বসে আছে, বসেই আছে। থাকতে না পেরে কিছুক্ষণ পর অস্থিরভাবে পায়চারি করা শুরু করল। আরও সময় গড়িয়ে গেল। আকাশে সূর্যের তেজ বাড়ছে ক্রমশঃ। তবু কারুর দেখা নেই। ডাকাডাকিও বহু করল শিয়ালনী, কিন্তু সে হাঁকডাকও গাছপালার ভিড়ে যেন হারিয়ে গেল। বাধ্য হয়েই শেষটায় গুটি গুটি পায়ে ওদের খুঁজতে বেরোল শিয়ালনী।
অনেকদূর গিয়ে পশুয়াদের হইহট্টগোলের আওয়াজ কানে এল তার। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে পৌঁছেই শিয়ালনীর চোখ একেবারে নলেন গুড়ের রসগোল্লা! ‘প্রত্যূষ আহারে’র পোঁটলার উপর হামলে পড়েছে সকলে। হাতুশি শেষে পৌঁছেছে বলেই বোধহয় ঝপাঝপ কচুরি, রসগোল্লা শুঁড়ে করে সেঁধিয়ে নিচ্ছে মুখের ভেতর। কুমরু আর ভালকিরও থাবাভর্তি খাবার। হিনিমিনিও ডজনখানেক কলা নিয়ে তরিবত করে খাচ্ছে। খালি বাঘু একপাশে দাঁড়িয়ে থাবা চাটছে। এতক্ষণে তার পেট ফুলে ঢোল!
শিয়ালনী দেখেই জোর শোরগোল উঠল একটা, “এই যে, দিদিমণি এসে গেছেন!”
হাতুশি একটা মটরশুঁটির কচুরি ভর্তি শালপাতার থালা বাড়িয়ে দিল দিদিমণির দিকে, “আমি জানতাম দিদিমণি, আপনি এসে পড়বেন। তাই আপনার জন্য সব গুছিয়ে রেখেছি।”
ভালকি আর কুমরু শালপাতার বাটিতে আলুর দম আর রসগোল্লা বাড়িয়ে দিল। হিনিমিনি গোটাচারেক পুরুষ্টু মর্তমান কলা দিল দিদিমণিকে। শিয়ালনী একটা জোর বকুনি দেবার তোড়জোড় করছিল, কিন্তু মুখে কচুরি- আলুর দম পুরে বকেই বা কী করে? বাঘু বেশ বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব করে বলল, “যা হয়েছে, তা ভালোই হয়েছে। কী বলুন, দিদিমণি?”
মুখের খাবারটা শেষ করেই ভুরু কোঁচকাল শিয়ালনী, “এই তুই-ই যত নষ্টের গোড়া! এতক্ষণ আমরা ঝালুমালু পৌঁছে যেতাম। ওখানে গিয়ে আরও আরাম করে বসে ভালোভাবে খাওয়া যেত!”
বাঘু থাবা চাটতে চাটতেই উত্তর দিল, “দিদিমণি, আপনি খালি আমাকেই বকেন! আর ওরা যে কেউ ফিরে গেল না, তার বেলা?”
হিনিমিনি আরেকটা কলার খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে জবাব দিল, “বা রে! ফেরত যাবো কী করে? ফিরে বাকিদের ডাকতে গেলে ততক্ষণে তো তুই একাই সব সাবাড় করে ফেলতিস!”
হালকা ধমকধামক দিয়ে ওদের থামাল শিয়ালনী। আবার শুরু হল হাঁটা। ঝালুমালু গিয়েই পুলকে দিশাহারা সকলে! ভারি সুন্দর জায়গা। দিদিমণি যেমনটি বলেছিলেন, ঠিক তেমনটি। এতটা পথ হেঁটে এসে গরমে হাঁইফাঁই করছে সবাই। তাড়াতাড়ি পোশাক খুলে ফেলে থাবা ধরাধরি করে নাচতে নাচতে ছড়া কাটতে শুরু করে দিল সকলে- চলো সবে ধরি হাত, বনভোজনে বাজিমাত! ছুটোছুটি, লুটোপুটি, একসাথে মেতে উঠি!
শিয়ালনী এক হাঁক দিল, “ওরে, শুধু নাচগান করলেই হবে? রান্নার জোগাড় করতে হবে তো! বাঘু আর কুমরু চলে যা, সবজি টবজি নিয়ে আয় ক্ষেত থেকে। কী কী আনবি জানিস তো? আলু, বেগুন, ফুলকপি, আর ইঁচড়। বাকি সব আমি নিয়েই এসেছি। হাতুশি, তুই আমাকে কয়েক বালতি জল এনে দে। কাঠকুটো আমি মোটামুটি নিয়ে এসেছি। হিনিমিনি, তুই আরও কিছু শুকনো ডালপালা জোগাড় করে দে। আর ভালকি, তুই মশলা আর যা যা আছে এই পোঁটলায়, সেগুলো বের করে গুছিয়ে রাখ। রান্নার জোগাড়টা একবার হয়ে যাক, তারপর তোরা যত খুশি খেলিস।”
ব্যস, বাঘু আর কুমরু লাফাতে লাফাতে চলে গেল একদিকে। হিনিমিনি লাফ দিয়ে গাছে গাছে ঘুরে ঘুরে শুকনো ডালপালা এনে জড়ো করছে। ভালকি মশলাপাতি বের করছে থলে থেকে। দিদিমণি শুকনো পাতা, ডালপালা দিয়ে উনুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন। কাছেই নদী। হাতুশি শুঁড়ে বালতি ঝুলিয়ে যাচ্ছে আর বালতি ভর্তি করে জল নিয়ে এসে রাখছে।
সেদিকে তাকিয়ে শিয়ালনী বলল, “হাতুশি, আর জল আনতে হবে না। আপাততঃ এতেই হবে। পরে দরকার হলে আবার আনিস। একটু খালি মশলাগুলো পিষে দিয়ে যা।”
নদীর জলে বড়োবড়ো পাথর। দুটো মসৃণ দেখে পাথর তুলে আনল হাতুশি। তার থাবার চাপেই ঝটাপট ঝটাপট মশলা পেষাই হয়ে গেল। এদিকে হিনিমিনির আলু কাটা ততক্ষণে শেষ। শিয়ালনী হাসি হাসি মুখে মাথা নাড়ল, “এইবারে আমি রান্না করি। তোরা যা। খেলবি খেল, ঘুরবি ঘোর, নাচবি নাচ- মোট কথা যা মন চায় কর। খালি বেশি দূরে যাস না।”
হইহই করতে করতে বেরিয়ে পড়ল ওরা তিনজনে। হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি।
এদিকে বাঘু আর কুমরু পৌঁছে গেছে সবজি ক্ষেতের কাছে। বেগুন গাছ চেনা সহজ। গাছ থেকে বেগুন ঝুলছে। ফুলকপিও তাই। খালি কোন গাছে আলু ঝোলে, সে আর খুঁজে পেল না ওরা। কুমরু একবার বলতে গেল, “বুঝলি, মনে হয়, আলু মাটির নিচে ফলে।” বাঘু পাত্তাই দিল না, “ধুস, তুইও যেমন। এর পর তো বলবি, নারকেলও মাটির নিচে ফলে! হে হে হে হে!”
বেজায় দমে গেল কুমরু। কিন্তু আর কিছু বলল না। শেষমেষ কোথাও কিছু না পেয়ে মাঠের ধারে ঘাস খেতে থাকা একটা গোরুকেই জিজ্ঞেস করল কুমরু, “নমস্কার, গোরুমহাশয়! বলতে পারেন কি এখানে আলুগাছ কোথায় আছে?”
গোরুমহাশয় ওদের দেখে মাথার শিং নাড়ালেন কয়েকবার। তারপর বললেন, “তোমরা কে? আগে তো দেখিনি।”
বাঘু খুব গর্ব গর্ব গলায় বলল, “আমরা? আমরা পড়ি শিয়ালনীর পাঠশালায়? নাম শুনেছেন নিশ্চয়ই। এখানে বনভোজনে এসেছি।”
শিয়ালনীর পাঠশালার নাম শুনেই গোরুমহাশয়ের চোখমুখ উদাস হয়ে গেল, “শিয়ালনীর পাঠশালা? সে তো শুনেছি বেজায় জব্বর পাঠশালা! আমি পাঠশালায় পড়িনি কিনা, তাই গোমুখ্যুই আছি! সারাজীবন গোরু হয়েই থেকে গেলাম!”
কুমরু দেখে, আসল কথাটাই চৌপাট হয়ে যাচ্ছে। তাই তাড়াতাড়ি করে বলল, “আর আলুগাছ?”
“আলুগাছ? এই তো, তোমাদের সামনেই। দেখতে পাও না? নাও না, কত নেবে।” ওরা তাকিয়ে দেখে, ঘন সবুজ রঙের ছোট ছোট গাছে ভরে আছে ক্ষেত। বাঘু অবাক, “কিন্তু আলু কই? আলু তো গাছে একটাও ধরে নেই!”
তাই শুনে গোরুমহাশয়ের সারা শরীর কাঁপিয়ে কী হাসি! “আরে, আলু কি গাছে ফলের মতন ফলে? আলু তো ফলে মাটির নীচে। এসব কথা জানো না বুঝি?”
বাঘু আমতা আমতা করে বলল, “জানবো না কেন? খুব জানি। আলু পটল তো মাটির নীচেই ফলে।”
তাই শুনে গোরুমহাশয়ের আবার একচোট হাসি, “আরে, পটল তো মাটির ওপরে গাছে ফলে! না বাবা, আমার গোমুখ্যু থাকাই ভালো। এসব অন্ততঃ জানি।”
বলেই গোরুমহাশয় লেজ তুলে দৌড়োতে শুরু করে দিলেন। এদিকে কুমরু ততক্ষণে মাটির নীচ থেকে আলু তুলতে শুরু করেছে।
আলুর পর বেগুন। ফুলকপি আগেই নেওয়া হয়ে গেছে। বেগুনক্ষেতের কাঁটার ভয়ে বাঘু আর যেতে চায় না। খালি বলে, “আমার গায়ে কাঁটা লেগে যাবে। ও হো হো হো।”
একেই আলুর ব্যাপার নিয়ে হাসাহাসি করায় কুমরু বেজায় খেপে ছিল। এইবারে রেগেমেগে থাবা ছুঁড়ল, “বাঘুউউ! তোর গায়ে কাঁটা লাগবে, আমার লাগবে না? খবরদার, চালাকি করবি না। দিদিমণিকে গিয়ে সব বলে দেবো। তোর জন্য কেমন বেইজ্জত হতে হল দেখলি? সেই তো মাটির তলা থেকেই আলু বেরোল! জানিস না, শুনিস না, অত বড় বড় বোলচাল কিসের?”
বাধ্য হয়ে কুমরুর সঙ্গে বেগুন তুলল বটে বাঘু, কিন্তু মনে মনে চটল বেজায়।
বেগুন তোলা শেষে কুমরু বলল, “বাঘু, আমি আলু, ফুলকপি আর বেগুন নিয়ে দিদিমণির কাছে পৌঁছে দিচ্ছি। নইলে আবার রান্নার দেরি হবে। তুই এঁচোড় নিয়ে আয়। গাছ চিনিস তো? কাঁঠাল গাছ? এঁচোড় নামের গাছ হয় না। কাঁঠাল গাছেই এঁচোড় হয়। নইলে আবার হয়তো তুই এঁচোড়ের গাছ খুঁজবি! হিহি হিহি হিহি।”
বলেই বাঘুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে পিঠটান দিল কুমরু।
কুমরুকে কী করে জব্দ করা যায় তাই ভাবতে ভাবতে চলল বাঘু। ওপাশে কয়েকটা কাঁঠাল গাছ আছে দেখেছে। এঁচোড়ও ফলে আছে। নিলেই হল। একটা এঁচোড় বোঁটা সহ তুলতেই সাদা খানিকটা রস পড়ল ঝরঝরিয়ে। বাঘু জানেই না যে ওটা কাঁঠালের আঠা। সে ভাবল, বাঃ! ভালোই হল। এই রসটা মুখে মেখে ভূত সেজে বেশ কুমরুকে ভয় দেখানো যাবে! সেই ভেবে খানিকটা রস থাবায় নিল বাঘু। আর নিতেই থাবা চটচট। থাবার আঙুল অব্দি ছাড়ানো যায় না। এদিকে আরও এঁচোড় নেওয়া বাকি। আর যত নিতে যায়, ততোই আঠা লাগে। ভুল করে গা মাথা চুলকোতে গিয়ে আরও বিপত্তি। এইরকম গুরুতর সময়ে দূর থেকে ভেসে এল কাদের যেন ডাক, “বাঘুউউ! বাঘুউউউউ!”
চমকে দেখে বাঘু, ধেয়ে আসছে হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি! বাঘুকে দেখে ওদের সে কী হাসি! “ই কী রে! সারা গায়ে কাঁঠালের আঠা মেখে কী সঙ সেজেছিস?”
বাঘু বেচারি পড়ল ফাঁপরে। কোনমতে ঢোক গিলে বলল, “ইয়ে মানে… ভূত সাজতে গিয়ে… মানে ভূত সাজাও নয়… মানে ইয়ে… মানে কুমরু… মানে কুমরুটা জ্বালাচ্ছিল এত… মানে ওকে ঠিক ভয় দেখাতে চাইনি… মানে অল্প একটু ইয়ে মানে ভয় দেখানো… ঠিক ভয়ও নয়… মানে ভয় দেখালে ভয় পেতে পারে তো… মানে ওই আর কী… হিহিহিহি…।”
ব্যস, ওরা তো বুঝল যা বোঝার। ভালকি বলল, “বেশ হয়েছে, যেমন ভূত সেজে ভয় দেখাতে গেছলি!”
হাতুশি হাসতে হাসতেই বলল, “কিন্তু বাঘুর গায়ের আঠা তোলা যাবে কী করে?”
হিনিমিনি আশ্বাসের ভঙ্গিতে বলল, “কিচ্ছুটি ভাবিস না বাঘু। আমি এই যাবো আর আসবো। ওদিকের একটা গাছে দেখলাম অনেক পাতিলেবু ধরে আছে। নিয়ে আসছি। গায়ে ঘষবি। আঠাটা চলে যাবে।”
যাইহোক, বাঘু কিছুটা সাফসুতরো হবার পর এঁচোড় নিয়ে ওরা গেল দিদিমণির কাছে। হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি একটা বল নিয়ে খেলা শুরু করে দিল। বাঘু খেলায় যোগ দিল না। সে গেল নদীতে চান করতে। নদীতে চান করতে করতে ঠাণ্ডা মাথায় কুমরুকে জব্দ করার একটা ফন্দি আঁটা দরকার!
নদীর কাছে গিয়ে জলে যেই না একটা থাবা দিয়েছে বাঘু, অমনি কে যেন তার থাবাটাকে আলগা করে টেনে ধরে সড়াত করে টেনে নিয়ে চলল আরও গভীর জলের দিকে। হাঁউমাঁউ করে উঠল বাঘু, “ওরে বাবারে! মা রে! ওরে বাঘিপিসী রেএএএএ! আমার সাঁতার শেখা এখনো শেষ হয়নি রে এএএ! আমাকে ছেড়ে দে রে রেএএএএ! ওরে তুই যা বলবি তাই করবো রে এএএএ! আজ রান্নার সব মাংসটাই তোকে দিয়ে দেবো রেএএএএ!”
জলের তলা থেকে একটা গম্ভীর আওয়াজ এল, “ঠিক বলছিস? তোর ভাগের সব মাংস দিবি?”
খাবি খেতে খেতে কোনমতে বলল বাঘু, “হ্যাঁ অ্যা অ্যাঅ্যা অ্যা। বলছি তো। আমার ভাগের সব মাংস আপনাকে দিয়ে দেবো, স্যার। এখন দয়া করে ছেড়ে দ্যান, স্যার। আমি বলে গরীব বাঘ, বেচারা বাঘ, স্যার! এট্টু দয়া করেন, স্যার!”
পায়ের থেকে আচমকাই ভারটা সরে গেল বাঘুর। জলের মধ্যেই নাকানিচোবানি খেতে খেতেই বাঘু দ্যাখে, তার সামনেই ফ্যাক ফ্যাক করে দাঁত বের করে হাসছে কুমরু। তার মানে, এতসব কুমরুরই কাণ্ড! বেজায় চটে গেল বাঘু, “অ্যাইয়ো কুমরু, এটা কী হল?”
কুমরু হাসতে হাসতেই জলের মধ্যে বার দুয়েক ডিগবাজি খেয়ে বলল, “কী আর হল? একটু মজা হল। হিহিহিহি! তাহলে বাঘু, তোর মাংসের সব ভাগ আমার। হিহিহিহি!”
বাঘু হাতপা ছুঁড়ে বলল, “কভি নেহি। তোকে দেব মাংসের ভাগ? ইসস, কী আমার ঠাকুর্দা এলেন রে!”
কুমরু নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, “বেশ, ঠিক আছে। তাহলে আর একবার বরং তোর থাবাটাই ধরি!”
যেই না বলা, অমনি কোনরকমে হাঁচোড়পাঁচোড় করে পাড়ে উঠে পাঁইপাঁই দৌড় লাগাল বাঘু। হাতুশি, হিনিমিনি আর ভালকি তখন আসছিল চানে। হাতুশিকে ধাক্কা দিয়ে, হিনিমিনিকে গোঁত্তা মেরে, ভালকিকে ঠ্যালা দিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে কোনরকমে শিয়ালনীর কাছে গিয়েই ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ল বাঘু।
শিয়ালনী অতশত খেয়াল করেনি। বাঘুকে দেখে খুশিই হল, “বাঘু! এসে গেছিস? ভালোই হল। মাংসের ঝোলটা এই সবে বসল, এখন ফুটবে অনেকক্ষণ। আমি চট করে চানটা সেরে আসি। তুই বরং এখানে বসে বসে পাহারা দে। আর তুই খেতে চাইলেও কোন লাভ নেই। একদমই কাঁচা আছে। খবরদার যাবি না কিন্তু আগুনের কাছে!”
বাঘু আর কী করে? কত কিছু ভাল ভাল মতলব ভেঁজে রেখেছিল, একটাও কাজে আসছে না। এমনকি, চানটা অব্দি শান্তিতে করতে পারল না। সে একটু এদিক চাইল, একটু ওদিক চাইল, একটু গান করারও চেষ্টা করল। কিন্তু কোনকিছুই কেমন যেন জমল না। শেষকালে তার নজর গেল হাতুশিদের ফেলে যাওয়া বলের দিকে। ভাবল, বলটা নিয়েই একটু খেলা যাক বরং।
ছোট, লাল টুকটুকে একটা বল। বলটা নিয়ে খেলতে খেলতে তার আর কোন হুঁশই রইলো না। খেয়াল ফিরল যখন তার লাথির চোটে বল গিয়ে পড়ল মাংসের ঝোলে!
আরিব্বাস! কী কাণ্ড? বাঘুর মাথায় থাবা! কী আর করে? দিদিমণি বারণ করেছেন, তবু বাঘু আস্তে আস্তে গিয়ে উঁকি মারল ঝোলের দিকে।
ঠিক সেই সময়েই পেছন থেকে বাজখাঁই এক আওয়াজ, “ঠিক ধরেছি! তোর মন ছুঁক ছুঁক করছে না মাংস খাবার জন্য? তোকে বলে গেলাম, আগুনের কাছে যাবিনা, ফের গিয়েছিস?”
ওরে বাবা! পেছনে দিদিমণি যে! কোনমতে দৌড়ে পালিয়ে বাঘু একটু দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে পড়ল। ভালোই হল। জায়গাটা নিরিবিলি। কেউ এদিকে এলে দিব্যি ভূতের মতো গলা করে ভয়ও দেখানো যাবে! (অবিশ্যি ভূতের গলা কিরকম বাঘু জানে না। তাহলেও…)
হাতুশিরা চানটান সেরে ফিরল যখন, শিয়ালনীর রান্নাবান্না সারা। ওদের আর কাউকে ডাকেনি, একাই সব রান্না সেরেছে। খালি সময়মতো কুমরুকে না পাওয়ায় মাছের ধুন্ধুমারটা হয়নি। এমনি ভেজেই নিয়েছে। হাতুশিকে ডাকল শিয়ালনী, “হাতুশি, এই তরকারির খোসাগুলো তুই এই বড় ঝুড়িটায় করে নিয়ে ওই দূরের ঝোপে ফেলে দিয়ে আয়।”
হাতুশি চলল শুঁড়ে ঝুড়ি ঝুলিয়ে খোসা ফেলতে। একখানা ছোটখাটো ঢিবির আকারে রাশিরাশি খোসা পড়ল যেই ঝোপের উপর, অমনি ভেতর থেকে পাওয়া গেল বাঘুর আর্তনাদ! বাঘু হাঁইমাঁই করে উঠেছে, “ওরে, তুই কে রে? ভরদুপুরে আমার গায়ে খোসা ফেলিস রে! ওরে বাবারে! ওরে, তোর প্রাণে কি একটুও মায়া দয়া নেই রে? এমনিতেই বলে আমার এখনো মাংসের ঝোল খাওয়া হয়নি রে!”
খোসার পাহাড় সরিয়ে উঠে দাঁড়াল বাঘু। মাথায় ফুলকপির গোছা গোছা ডাঁটা, চোখের উপরে কাঁচকলার খোসা, নাকের ঠিক নিচে একটা এঁচোড়ের খোসা সুন্দর করে চিটিয়ে গেছে গোঁফের মতন। আদা, রসুন আর পেঁয়াজের খোসা সারা গায়ে যত্রতত্র। টোম্যাটোর একখানা টুকরো আবার চেপটে গিয়ে কপাল থেকে টুপটুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মতন ঝরে ঝরে পড়ছে।
হাতুশি না বলে পারল না, “কী অপরূপ রূপ তোর, বাঘু! বলিহারি!”
বাঘু দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “মাথা গরম করাবি না, হাতুশি! আমার গায়ে ময়লা ফেললি কেন?”
হাতুশি শুঁড় ওল্টাল, “বা রে! আমি কী করে জানবো যে তুই এখানে ঝোপের মধ্যে ঘাপটি মেরে আছিস?”
বলেই বাঘুকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সটান পিঠে তুলে দিদিমণির কাছে এনে ধপাস করে মাটিতে ফেলল হাতুশি! বাঘুর দশা দেখে সক্কলের সে কী হো হো হাসি! এমনকি, দিদিমণি অব্দি হেসে ফেলেছেন ফিক করে।
খেতে বসেছে সবাই। হাতুশির পাশে হিনিমিনি, তার পাশে ভালকি, তার পাশে কুমরু, আর কুমরুর পাশে? বাঘু ছাড়া আবার কে?
প্রতিটা রান্নাই দুর্দান্ত! খেতে খেতে আহ্লাদে চোখ বুজে আসছে সবার। এই না হলে বনভোজন! হাতুশি আর হিনিমিনিকে এঁচোড়ের তরকারি দিয়ে মাংসের ঝোলের কড়াই নিয়ে এসেছে শিয়ালনী। শালপাতার বাটিতে বাটিতে গরমাগরম মাংসের ঝোল সাজিয়ে দিল ঝটাপট। দেখেই বাঘুর জিভ উলুস উলুস! আর তারপরই চক্ষুস্থির! আরে, ঝোলের মধ্যে ওটা কী? সেই লাল বলটা না?!
এদিকে পাশে বসা কুমরু কাঁইমাঁই জুড়েছে, “কী কথা ছিল, বাঘু? কথা ছিল না, তুই তোর ভাগের পুরো মাংসটাই আমাকে দিবি? পুরোটা না দে, আদ্ধেক তো দিবি।”
বাঘু ভারি উদারতা দেখাল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। কথা যখন দিয়েছি, কথা রাখা আমার কর্তব্য।”, বলে সেই লাল বলের মতো টুকরোটা তুলে দিল কুমরুর পাতে।
এইবারে? এইবারে…। বড়সড়ো দেখে একটা মাংসের টুকরো মুখে পুরে পরমানন্দে চিবোতে গেল বাঘু। এক দু’বার চিবিয়েই তার আক্কেল গুড়ুম! এ কী! চিবোনো যায় না কেন? এত ছিবড়ে ভাবই বা আসে কোত্থেকে? একটা সুতোর মতোও লাগছে যেন!
মাংসের টুকরোটা মুখ থেকে বের করল সে। যতোই চিবোনো হোক, গায়ে জড়িয়ে থাকা সুতো থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় ওটা আসলে একটা বলই। কিছুক্ষণ আগেও যার রঙ ছিল লাল টুকটুকে।
এত দুঃখ কি আর বাঘুর প্রাণে সয়? মনের দুঃখে ভেউভেউ করে কেঁদেই ফেলল বাঘু, “ওরে, এ আমার কী সব্বোনাশ হল রেএএএ… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… মাংস ভেবে বল চিবোলাম রেএএএএ…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না) তাও আবার আমারই লাথি মারা বল রেএএএএ…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…ভূত সাজতে গিয়ে আঠাভূত হয়ে গেলাম রেএএএএ…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…বনভোজনে আমার বনে রোদন হয়ে গেল রেএএএ…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)…”
……০……
অংকনঃ গুঞ্জা
বাঘু সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি থাবাছানি দিচ্ছে নিচের লিঙ্কেঃ-