Home / ছোটদের গল্প / বাঘু খেল ঘাস- মৌসুমী পাত্র

বাঘু খেল ঘাস- মৌসুমী পাত্র

baghu khelo ghas- mp
বাঘু খেলো ঘাস

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা দিয়েছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ গল্পে। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে পাঠশালার খবর ভেসে আসে মাঝেমধ্যে। এলেই তোমাদের জানাতে থাকবো। পাঠশালাটা কোথায় জানো? বনের ঠিক সেই জায়গায়, যেখানে প্রচুর গাছপালা মিলে মাথার উপরে একটা চাঁদোয়ার মত বানিয়েছে, আর দুটো সেগুনগাছের ইয়া মোটা মোটা গুঁড়ি দুদিক থেকে এসে একটা দরজার মতো তৈরি হয়েছে। জঙ্গলের যত ছানাপোনা জন্তুজানোয়ার, সবাই আজকাল সক্কালবেলা হলেই হাতমুখ ধুয়ে চাট্টি মুড়ি খেয়ে ওখানেই পড়তে যায়। তাদের মধ্যে আছে বাঘিনীর বাচ্চা ছেলে বাঘু, হাতির বাচ্চা মেয়ে হাতুশি আর হনুমানের ছানা মেয়ে হিনিমিনি। এছাড়াও আছে ভালুকের পুঁচকি মেয়ে ভালকি আর কুমীরের বাচ্চা ছেলে কুমরু।)

পাঠশালা বলে জঙ্গলের এদিকটা বেশ শুনশান। ছানাপোনাদের পাছে পড়াশোনার ব্যাঘাত হয়, তাই বনের জন্তুজানোয়ারেরাও সহজে এ দিকটা মাড়ায় না। পাঠশালাটার ওপাশের মাঠটা তাই বড় বড় ঘাস আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি। মাঝেমধ্যে একটা দুটো গাই গোরু কিংবা বাছুর চরতে আসে আপন খেয়ালে।

প্রার্থনার পর শিয়ালনীর পাঠশালায় পড়াশুনো শুরু হয়েছে জোরকদমে। হাতুশি শুঁড়ে একটা বড়ো পেনসিল বাগিয়ে ধরে পড়াগুলো টুকছে। হিনিমিনি মন দিয়ে শুনছে, পরে হাতুশির দেখে দেখে লিখে নেবে।  ভালকি আর কুমরুও পড়া শুনছে মন দিয়ে। বাঘুও যে পড়া শুনছে না তা নয়। পড়াও শুনছে, আর দূরের মাঠে যে বাছুরটা ঘাস খাচ্ছে, ফাঁকফোকর দিয়ে তাকেও দেখছে।

হাতের ‘বনপরিচয়’ বইটায় চোখ বোলাতে বোলাতে চশমাটা নাকের ডগায় নামিয়ে আনল শিয়ালনী, “পড় সবাই- মৃগ তৃণ খায়।”

অমনিই ফস করে ভালকির প্রশ্ন, “দিদিমণি, মৃগ মানে কী?”

চশমার ওপরের ফাঁক দিয়ে তাকাল শিয়ালনী, “মৃগ? মৃগ মানে হরিণ।”

শিয়ালনীর উত্তর দেওয়া শেষ হতে না হতেই ভালকির প্রশ্ন ধেয়ে এসেছে, “তৃণ মানে কী, দিদিমণি?”

প্রশ্ন শুনে শিয়ালনী খুশিই, “বাঃ! বাঃ! গুড। এই তো, তোরা বেশ প্রশ্ন করতে শিখেছিস! সবসময় বুঝে বুঝে পড়বি। না বুঝে কোনকিছু পড়িস না। তোদের সব্বাইকেই[ বলছি। কুমরু, তৃণ মানে হচ্ছে ঘাস। মৃগ তৃণ খায় মানে হল, হরিণ ঘাস খায়। বুঝলি?”

শিয়ালনীর কথা শুনেটুনে বাঘুর আচমকা কী ভাবোদয় হোল কে জানে, সটান পিছনের থাবাদুটোয় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, দিদিমণি, হরিণ কেন ঘাস খায়?”

“গুড, গুড, বাঘু। তুইও তো বেশ প্রশ্ন করতে শিখেছিস দেখছি। বুঝলি, এই জানার আগ্রহটাই আসল। যত প্রশ্ন করবি, তত উত্তর পাবি, তত জানবি, তত শিখবি। বুঝলি কিছু?”

হাতুশি দেখল দিদিমণি আসল প্রশ্নটাই ভুলে যাচ্ছেন। সে তাই মিষ্টি করে শুঁড় দোলাল, “দিদিমণি, বাঘু জানতে চাইছে, হরিণ কেন ঘাস খায়?”

হিনিমিনিও গোল করে লেজ ঘোরাল, “এত কিছু খাবার থাকতে হরিণ ঘাসই বা খায় কেন?”

শিয়ালনী চশমাটাকে সামান্য কপালের উপর তুলে চোখদুটো মুছল। তারপর চশমাটা চোখে এঁটে নরম নরম চোখে চাইল সবার দিকে, “বুঝলি, এই প্রশ্নটাই আমি একবার একটা হরিণমাসীকে করেছিলাম। তাতে সে বলল, ঘাসের চেয়ে বড় সুখাদ্য নাকি আর কিছু নেই। তা কে জানে, হতেও পারে। গাইগোরুতেও তো ঘাসই খায়। মানুষ তো গাইয়ের দুধই খায়। মানুষেরাও তো আজকাল শুনছি, অনেকেই নাকি ঘাসের স্যুপ বানিয়ে খায়। নিশ্চয়ই কিছু ভালো গুণ আছে, নইলে খাচ্ছে কেন? তবে আমার কথা যদি বলিস, আমি কখনো খেয়ে দেখিনি। আমি তো আর ঘাসে মুখ দিয়ে চলি না।”

ভালকি মাথা দোলাল, “দিদিমণি, আমার লেজে একদিন কেটে গিয়েছিল। আমার মা দুব্বোঘাস থেঁতো করে একটা কাপড়ে করে বেঁধে দিয়েছিল।”

ঘাস নিয়ে আলোচনা তো বেজায় জমে গেছে। আর এদিকে বাঘু একমনে দেখছে, দূরের মাঠে বাছুরটা তারিয়ে তারিয়ে ঘাস খাচ্ছে, খেয়েই চলেছে।

টিফিনের সময় বাঘু আজ আর নিজের টিফিন খেলই না। সোজা দৌড়ল মাঠটায়। বাছুরটা দিব্যি আরাম করে ঘাস খেয়ে যাচ্ছে তখনও। বাঘু গিয়েই এক হুঙ্কার ছাড়ল, “অ্যাই বাছুরছানা, ইদিকে আয়।”

বাছুর তো ভয়ে ভয়ে এগিয়ে এলো বাঘুর কাছে, “কী বলছো, বাঘুদাদা?”

“কী? তোর এতোবড়ো আস্পর্ধা? আমাকে দাদা বলিস? শোন, আমি কারো দাদা ফাদা নই। আমি বাঘের বাচ্চা। আমি যখন বড়ো হবো না, ইয়াব্বড়ো পালোয়ান বাঘ হবো। বুঝলি?”, বলেই বাঘু নিজের থাবাদুটো যথাসম্ভব ফুলিয়ে টুলিয়ে দেখালো।

বাছুরের তো দেখেশুনে আক্কেল গুড়ুম। সে বেচারি নিরীহ বাছুর, সাতেপাঁচে থাকে না। কোনমতে ভয়ে ভয়ে ঘাড় নাড়ল। বাঘু মাঠের চারপাশটা ভালো করে দেখতে দেখতে বেশ ভারিক্কি চালে বলল, “আমাকে তুই বাঘুস্যার বলে ডাকবি। মাথায় ঢুকেছে?”

বাছুরটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তাই হবে, বাঘুস্যার।”

বাঘু বলল, “শোন, আমি আসলে খুব দয়ালু জানোয়ার। কারুর ক্ষতিটতি বিশেষ করি না। সবার ভালোই চাই। তা তোর ভালোর জন্যই একটা কথা বলছিলাম।”

বাছুর বেচারির মুখ শুকিয়ে গেছে। ভয়ে লেজ কাঁপছে। কোনমতে শুধোল, “কী বাঘুদাদা? ইয়ে মানে, বাঘুস্যার?”

বাঘু লেজখানা দোলাতে দোলাতে বলল, “শোন। আমাকে ভালো দেখে চাট্টি ঘাস এনে দে দেখি।”

বাছুর তো বেজায় অবাক, “কি হবে বাঘুস্যার ঘাস দিয়ে?”

“কী হবে না হবে তোর অত জেনে কাজ কী? তোকে ঘাস এনে দিতে বলেছি, এনে দে।”

ধমক খেয়ে বাছুর বেচারি তো বেছে বেছে ভালো কিছু কচি দূর্বাঘাস বড়ো একটা শালপাতায় মুড়ে এনে দিল বাঘুকে। বাঘু ঘাস নিয়ে একদৌড় দিল একটু দূরের একটা বটগাছের দিকে। বটগাছের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ছায়ায় আরাম করে বসে মোড়কটা খুলল বাঘু। তারপর আরাম করে ঘাস চিবোতে শুরু করল। দুব্বোঘাসের রস যে এতো ভালো খেতে বাঘুর ধারণাই ছিল না। যত খায়, তত যেন আরো খেতে ইচ্ছে করে। চিবোতে চিবোতে বাঘুর দুচোখ আরামে বুজে এল। আর বটগাছের তলাটায় কী যে আরাম! ঝিরিঝিরি ঠাণ্ডা হাওয়ারা যেন মনের সুখে হেসে খেলে বেড়াচ্ছে পুরো জায়গাটা জুড়ে। গাছের ডালে পাখিদের কিচিরমিচির ছাড়া আর কোথাও কোন শব্দ নেই। ধীরে ধীরে বাঘুর ঘাড় একপাশে হেলে পড়ল, চোখের পাতা বুজে গেল ধীরে ধীরে।

 

টিফিন শেষের পর ক্লাসে ঢুকেই শিয়ালনী অবাক। বাঘু কই? বাড়ি চলে গেল নাকি? কিন্তু কিছু না বলে চলে যাবে এত তো অবাধ্যও নয়। চিন্তিত মুখে শিয়ালনী জিজ্ঞেস করল পোড়োদের, “হ্যাঁ রে। বাঘু কোথায়? দেখছি না যে!”

শুনে এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। হাতুশি শুঁড় দোলায়, “দিদিমণি, টিফিনে তো বাঘুকে আজ তেমন দেখতে পাইনি। আজ আমাদের সঙ্গে খেলেওনি।”

কুমরু বলে, “দিদিমণি, আমরা কিতকিত খেলছিলাম আজ। বাঘুও অন্যদিন আসে খেলতে। আজ তো কই আসেনি।”

হঠাৎ ভালকি এক লাফ দেয়, “দিদিমণি, আমার মনে পড়েছে। বাঘুকে আমি কিন্তু একবার ওপাশের মাঠের দিকে যেতে দেখলাম যেন।”

“তাই না কি রে? তাহলে একবার হাতুশি, তুই হিনিমিনিকে নিয়ে ওপাশের মাঠটায় ঘুরে আয়। দেখ, যদি কোন সন্ধান পাস। কোন আপদবিপদ হোল নাকি ছেলেটার- তাই বা কে জানে? যা দুষ্টু!”

হাতুশি হিনিমিনিকে পিঠে চাপিয়ে লাফাতে লাফাতে চলল ওপাশের মাঠে। সেখানে তখন বাছুরটা ঘাস খাওয়া সেরে বাড়ি যাবার জন্য সবে পা বাড়িয়েছে। হাতুশি আর হিনিমিনিকে দেখে বাছুরটা ভারি অবাক, “কী গো, দিদিরা, তোমরাও কি ঘাস নিতে এসেছো?”

হিনিমিনি অবাক হয়ে শুধোল, “মানে? আর কে ঘাস নিতে এসেছিল?”

হাতুশি চোখদুটো পিটপিট করল, “খামোকা ঘাস নিতেই বা যাবো কেন?”

বাছুরটা লেজটা পাঁইপাঁই করে দুবার ঘুরিয়ে লেজে বসে থাকা একটা মাছিকে তাড়াল। তারপর বলল, “কেন, বাঘুদাদা মানে বাঘুস্যার যে খানিকক্ষণ আগে এসে এতো এতো দুব্বোঘাস নিয়ে গেলেন!”

শুনেটুনে তো ওদের চোখমুখ গোলগোল। বাঘুদাদা, মানে, বাঘুস্যার? ব্যাপারখানা কী? হাতুশি বলে ওঠে, “হ্যাঁ রে, তা তোর বাঘুস্যার গেলেন কোনদিকে?”

বাছুরটা সামনের ডানদিকের পা তুলে দেখায়, “ওই যে, ওইদিকে। বটগাছটার দিকেই যেতে দেখলাম।”

বাছুরকে টা টা করে হাতুশি আবার হাঁফাতে হাঁফাতে দৌড়তে থাকে। পিঠে হিনিমিনি। বটগাছের কাছে পৌঁছে গিয়ে তো ওরা অবাক। বটগাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে পরম আরামে ঘুমোচ্ছে বাঘু, কোলের ওপর কিছু ঘাসের গোছা। আর বাঘুর হালকা হালকা নাক ডাকছে – ঘুঁ-উ-উ-উস! পুঁ-উ-উ-উস! ঘুঁ-উ-উ-উস! পুঁ-উ-উ-উস!

হিনিমিনি তড়াক করে লাফিয়ে পড়ল হাতুশির পিঠ থেকে। বাঘুর কাছে গিয়ে লেজে সুড়সুড়ি দিয়ে শিয়ালনীর গলা নকল করে ডাকল, “বাঘু! বাঘুউউউউউ!”

হাতুশি ততক্ষণে শুঁড় দিয়ে কাতুকুতু দিতে শুরু করেছে বাঘুকে। বাঘু এদিকে খুব মন দিয়ে স্বপ্ন দেখছিল। বাঘুর জন্মদিনে বাঘুর মা বাবা মিলে দুব্বোঘাসের লুচি, দুব্বোঘাসের পায়েস বানিয়েছে। বাঘুর পছন্দ হয়নি। সে গানের সুরে বায়না জুড়েছে- তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার ঘাসের কেক চাই। তখন কোনদিক থেকে শিয়ালনী দিদিমণি দৌড়ে এসেছে- বাঘু, আজ তোকে ঘাসের অংক দেবো। ধর, সারাদিনে তোকে দশ আঁটি ঘাস দেওয়া হলো। তুই খেতে পারলি সাত আঁটি। তাহলে কত আঁটি পড়ে রইলো? বাঘু তখন কাঁদোকাঁদো হয়ে বলল, দিদিমণি, আগে সত্যিকারের ঘাস দিন, তবে তো অঙ্ক করবো। এ কথায় শিয়ালনী খুব রেগে গিয়ে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে চেঁচিয়েছে- বাঘু! বাঘুউউউউউউ! হাতুশি আর হিনিমিনিও কোনদিক থেকে দৌড়ে এসে চেঁচাতে শুরু করেছে- বাঘু! বাঘুউউউউউউ!

ধীরে ধীরে চোখ খুলল বাঘু। হাতুশি তার সামনে কোমর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। হিনিমিনি তুড়ুক তুড়ুক লাফ দিচ্ছে। বাঘু তার গলাটা সামান্য ঝেড়ে পরিষ্কার করল- “কী রে, অত হাসাহাসির কী আছে?”

“তা হাসব না? ক্লাস ফাঁকি দিয়ে কোলে ঘাস নিয়ে এখানে আরাম করে পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিস!”, রাগ রাগ গলা হাতুশির।

“বাঘু! চল, ওঠ। অনেকক্ষণ ক্লাস শুরু হয়ে গেছে। দিদিমণি তোর খোঁজ নিতে পাঠালেন।”, হিনিমিনি বাঘুর সামনের থাবা ধরে টানতে শুরু করে দিয়েছে।

এতক্ষণে সব মনে পড়ে বাঘুর। গায়ে লেগে থাকা ঘাসগুলো ঝেড়েঝুড়ে ফেলে আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। জিভ কেটে বলে, “ইসসস! তাই তো রে! বড্ডো দেরি হয়ে গেছে।”

হাতুশি শুঁড়খানা গালে ঠেকায়, “ও কী রে বাঘু? তোর জিভখানা অমন সবুজ সবুজ কেন?”

হিনিমিনি লেজ নাড়ে, “তাই তো রে! বাঘু, তোর মুখেও তো দেখছি একটা ঘাস লেগে আছে। তুই কি ঘাস খাচ্ছিলি?”

বাঘু দেখে মহা বিপদ। তড়িঘড়ি করে বলে, “না মানে, ওই বাছুরটা… মানে আসলে … এমন করে বলল… মানে ঠিক খাইনি… মানে ওই আর কী… মানে ওই ইয়ে… মানে, একটু চাখছিলাম আর কী।”

হাতুশি আর হিনিমিনি শুনেই হো হো করে হাসতে শুরু করে দিল। বাঘু চোখ সরু করে বলল, “হাসছিস যে বড়? একদম হাসবি না। জানিস, দুব্বোঘাস খেতে কত টেস্টি। খেলে তো বুঝবি।”

তাই শুনে হাতুশি আর হিনিমিনি হাসতে হাসতে মাটিতে গড়িয়েই পড়ে প্রায়। বাঘু বেচারি রাগের চোটে দৌড়তে শুরু করে দিল। হাতুশি আর হিনিমিনি ধাওয়া করল পিছন পিছন।

শিয়ালনী ওদের তিনজনকে দেখে ব্যস্ত হয়ে উঠেই পড়েছে, “হ্যাঁ রে বাঘু, তুই ছিলি কোথায়? কী রে হাতুশি, হিনিমিনি- বাঘুকে তোরা পেলি কোথায়?”

হাতুশি আর হিনিমিনি তো বলল সব কথা। শুনতে শুনতে শিয়ালনীর মুখচোখ প্রথমে গোলগোল হোল। তারপর মুখ বন্ধ হোল, চোখদুটো প্রায় কপালে উঠল। সবশেষে শিয়ালনীর চোখও বন্ধ হয়ে গেল। খালি তার লেজখানা পাঁইপাঁই পাঁইপাঁই করে ঘুরতে থাকল তো ঘুরতেই থাকল।

তাই দেখে কুমরু ভয়ে ভয়ে ডাকল, “ও দিদিমণি!”

ভালকি কাছে এগিয়ে গেল, “ও শেয়াল মিস!”

ডাকাডাকিতে চোখ খুলল শিয়ালনী, “ওরে, বাঘু রে! আমি হাসব নাকি কাঁদব রে! বাঘের বাচ্চা হয়ে তুই ঘাস খেলি রে বাঘু! ও হো হো হো!”

হাতুশি দেখল, তালেগোলে দিদিমণি পড়ানোর কথাই ভুলে গেছে। সে তাই তাড়াতাড়ি বলল, “দিদিমণি, আজ আমাদের পড়াবেন না?”

চমকে উঠে শিয়ালনী বলল, “তাই তো রে! এই বাঘুর জ্বালায় সব ভুলে যেতে বসেছি। ঠিক আছে, তোরা সবাই ঠিকঠাক করে বোস, আমি এক্ষুণি তোদের অংক করতে দিচ্ছি। আর বাঘু বাছাধন, ফের যদি তোমাকে ঘাস খেতে দেখেছি না, তবে কিন্তু তোমার কপালে দুঃখু আছে। এই বলে রাখলাম।”

অঙ্ক করতে দিয়েছে শিয়ালনী। তারপর চশমা চোখে এঁটে অঙ্কের বইটা নিয়ে কিসব দেখছে। দেখতে দেখতে শিয়ালনীর হাই উঠতে শুরু করেছে। অমনি বাঘু দিদিমণির হাই গোনা শুরু করেছে- এক, দুই, তিন।

বাঘুর সামনে বসা হিনিমিনি হাতুশিকে শুধোল, “হাতুশি, প্রথমের যোগটা করলি?”

হাতুশি উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

তাই শুনে বাঘু তাড়াতাড়ি করে খাতাটায় চোখ বুলোয়। প্রথম অঙ্ক- তিন আর দুই এ যোগ। বাঘু ভাবল, দিদিমণি তো তিনটে হাই তুলেছে। আর দুটো হাই তুললেই গুনে ফেলবো। একটু পরেই শিয়ালনী আরো দুটো হাই তুলল। বাঘুও তক্কে তক্কে ছিল। দুটো হাই তুলতেই গুনে ফেলল চটপট। তারপর উত্তর লিখল পাঁচ।

এর পরের যোগ পাঁচ আর তিন। বাঘু আবার পাঁচের পর থেকে পরপর তিনটে হাই গুনল। তারপরে লিখল আট।

তারপরের যোগ ছিল আট আর দুই-এর। আরও দুটো হাই গুনল বাঘু। উত্তর দাঁড়াল দশ।

সবার শেষের যোগ ছিল দশ আর আট। বাঘু বসেই আছে, বসেই আছে। শিয়ালনী হাই তুললে গুনে নিয়ে অংকটা করবে বলে। শেষমেষ শিয়ালনী তিনটে হাই তুলে আর তুলল না। বাঘু বেচারাই বা তাহলে কী করে? উত্তর লিখল তেরো। আর তার সঙ্গে কিসব হিজিবিজি লিখে খাতাটা জমা দিয়ে এল।

একটু পরে সবার খাতা দেখতে শুরু করেছে শিয়ালনী। হাতুশি, হিনিমিনি, ভালকি, কুমরু- সবাই সব অঙ্ক ঠিকঠাক করেছে। সবার শেষে বাঘুর খাতা। প্রথম তিনটে অঙ্ক একদম ঠিক। শিয়ালনী খুব খুশি হয়ে আপনমনেই বলে উঠল, “বারে বা! বাঘু রে! তুই তো দেখি দারুণ মন দিয়ে পড়াশুনো করছিস আজকাল। এরকম করলে তো তুই পুরো একশোয় একশো পাবি রে!”

বলতে বলতেই চার নম্বর অঙ্কের দিকে নজর গেছে শিয়ালনীর। আর সঙ্গে সঙ্গেই চোখমুখ কুঁচকে গেছে তার, “ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা। এটা কী করেছিস রে? দশের সঙ্গে আট যোগ করলে তেরো হয়? অ্যাঁ? আবার কিসব লিখেছিস দেখি। অ্যাঁ? অ্যাঁ? দিদিমণি আর হাই তুলল না বলে আমার উত্তর তেরোতেই শেষ করতে হোল!… আটখানা হাই তোলার কথা ছিল…। অ্যাঁ? এসব কী লিখেছিস বাঘু? অ্যাঁ? আমার হাই গোনা হচ্ছিল, না?”

বাঘু বেচারি বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “ইয়ে… মানে… হ্যাঁ দিদিমণি… মানে না দিদিমণি… মানে ইয়ে… মানে আপনার হাই ঠিক গুনিনি… মানে না গোনাও নয়… মানে একরকম গোনাই বলা চলে… মানে আগের বারগুলো আপনি ঠিকঠাক হিসেবমত হাই তুলেছিলেন… আর শেষের বেলা তুললেন না? এটা কি ঠিক হোল? আমার অঙ্ক ভুল হয়ে গেলোওওওওওও…ওঁ ওঁওঁ ওঁ…।”

শিয়ালনী দাঁত কিড়মিড় করছে, “আমি কোন কথা শুনতে চাই না বাঘু। এতক্ষণ ধরে আমার হাই গোনা হচ্ছিল, না? খুব হাই গুনতে শিখে গেছিস!  এক্ষুণি লম্বাগুড়ি দিবি। গুনে গুনে তেরোবার।”

বেচারা বাঘু আর কী করে? চোখমুখ শুকনো করে ‘লম্বাগুড়ি’ দিতে শুরু করল।

মানুষেরা যখন চার হাতে পায়ে হাঁটে, সেটাকে বলে হামাগুড়ি। আর চারপেয়েরা পিছনের দুপায়ে ভর দিয়ে আর সামনের দুপা সোজা করে তুলে দৌড়লে তাকে বলে লম্বাগুড়ি।

তা এরকম লম্বাগুড়ি দিতে হলে তো কষ্ট হবারই কথা। বাঘুও তেরোখানা লম্বাগুড়ি দিয়েই হাঁফিয়ে গেল। শিয়ালনী জোর গলায় ধমক দিল বাঘুকে, “বাঘু মনে থাকে যেন। ফের যদি তোর কোনরকম বেচাল দেখি, তাহলে কিন্তু তেরো দশে একশ তিরিশখানা লম্বাগুড়ি দেওয়া করবো।”

 

পরের কয়েকটা দিন কিন্তু বাঘু সত্যি সত্যিই অদ্ভুতরকমের ভালো হয়ে গেল। কোথাও কোন রকমের উৎপাত নেই। ক্লাসের পড়াশুনোতেও মন দিয়েছে। খালি টিফিনের সময় তার আর পাত্তা পাওয়া যায় না। যাই হোক, গোলমাল করছে না বলে কেউ আর ওই নিয়ে বিশেষ মাথাও ঘামায়নি।

দিনসাতেক পরে। সকালবেলায় শিয়ালনী এসে রচনা লিখতে দিয়েছে। দুটো রচনা দিয়েছে পোড়োদের- ‘আমাদের বন’ আর ‘মানুষ।’ যেকোন একটা লিখতে হবে। বাঘু বাদে বাকিরা লিখছে ‘আমাদের বন।’ বাঘু ‘মানুষ’ রচনা লিখেটিখে খাতা জমা দিয়ে এল।

শিয়ালনী বাঘুর রচনা পড়া শুরু করল-

             মানুষ একটি অদ্ভুত জন্তু। মানুষের দুটি পা, দুটি হাত, দুটি কান, দুটি চোখ, একটি মাথা ও একটি পেট আছে। কোন লেজটেজ নাই। লেজ নেই বলে মানুষের মহা অসুবিধে। মশামাছি তাড়াতে পারে না। দরকারেও লেজ চুলকোতে পারে না। লেজ না থাকার রাগে মানুষেরা বাকিদের ওপর জুলুম করে বেড়ায়। মানুষেরা আমাদের মত পাঁইপাঁই করে দৌড়তে পারে না। গায়ে আমাদের মত জোরও নেই। আমি বা হাতুশি একটা ঘুঁষি দিলে যেকোন মানুষ উলটে পড়ে যাবে। অনেক মানুষ আবার গাছ কাটে। তাদেরকে আমি গিয়ে রাতের বেলা ভয় দেখাবো ঠিক করেছি। মানুষেরা আবার ঘরবাড়ি বানিয়ে তার মধ্যে থাকে। আমাদের মত থাকতে হলে মজাটি টের পেত! মোটকথা, মানুষ একটি  অতি বিচ্ছিরি রকমের জন্তু। …

 

এই অব্দি পড়েছে শিয়ালনী, এমন সময় বাইরে হেঁড়ে গলায় জোর জোর হাম্বা ডাক শোনা গেল। পোড়োরা অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে, সেদিনের সেই বাছুরটা তার বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শিয়ালনী অবাক হয়ে বলে, “আসুন, আসুন, গোরুমশাই। এখানে এসে বসুন।”

গোরুমশাই গম্ভীর গলায় বলেন, “বসতে আসিনি। ওই যে, ওইটাই সেই বাচ্চা বাঘ! যে আমার ছেলের ঘাস রোজ একবস্তা করে খায়?”

শিয়ালনী অবাক হয়ে বলে, “বস্তা… ঘাস… এসব তো আমি কিছুই বুঝতে পারছি না, গোরুমশাই।”

গোরুমশাই জোরে জোরে শিং নাড়ান, “আপনার বোঝার কথাও নয়। জিজ্ঞেস করুন আপনার ওই ছাত্রকে, ও সব জানে।”

সবার চোখ ঘুরে যায় বাঘুর দিকে। বাঘু তখন ভয়ের চোটে কুঁকড়ে মুঁকড়ে বসে আছে। শিয়ালনী গমগমে গলায় শুধোয়, “বাঘুউউউ, কী ব্যাপার? তোমার নামে অভিযোগ কেন?”

গোরুমশাই প্রবল বেগে লেজ নাড়েন, “আমি বলি। আপনার এই ছেলেটি- বাঘু না বেঘো কী যেন নাম- ও আমার ছেলেকে গিয়ে শাসিয়ে এসেছে, রোজ যেন ওকে এক বস্তা করে কচি দুব্বোঘাস দেওয়া হয়। না হলে ও নাকি তুলকালাম করে ছাড়বে। এই মাঠটায় ভালো কচি ঘাস আছে বলে আমি এই মাঠটা ওর জন্যই ছেড়ে রেখেছিলাম। তা আপনার ছাত্রের ঘাস খাবার চোটে মাঠের ঘাস প্রায় ফাঁকা। এমন হলে কী করে চলে, আপনিই বলুন। আর বাঘ হয়ে ওর ঘাস খাবার দরকারটাই বা কী?”

আকাশ- বাতাস কাঁপিয়ে এক হুঙ্কার দেয় শিয়ালনী, “বাঘু! বাঘুউউউউউ! ইদিকে আয়। বলি, ইদিকে আয়। তোকে আমি আগের দিনই বলেছিলাম, কোনরকম বেচাল দেখলে তোকে কিন্তু এবার একশ তিরিশ খানা লম্বাগুড়ি দিতে হবে। নে, শুরু কর।”

মনের দুঃখে ফোঁপাতেই শুরু করল বাঘু, “আঁই আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… ওরে, ঘাসে কেন মুখ দিয়েছিলাম রে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)… আমাকে এখন একশ তিরিশ খানা লম্বাগুড়ি দিতে হবে… আঁই আঁই আঁই আঁই (কান্না)।”

শিয়ালনী এক ধমক দিল, “বাঘু, দেরি না করে শুরু কর তাড়াতাড়ি। দেরি করলে কিন্তু আরো বেশি লম্বাগুড়ি দিতে হবে বলে দিলাম।”

বেচারি বাঘু আর কী করে? ফোঁপাতে ফোঁপাতেই শুরু করল লম্বাগুড়ি দিতে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে আর হাসছে। ভালকি এতক্ষণ খাতায় কীসব লিখছিল। এবারে খাতা দেখে সুর খেলিয়ে গান জুড়ল—

 

         ঘাস খেয়ে বাঘুস্যার কাবু হলেন রে…

          লম্বাগুড়ি দেন বাঘু, সবাই হাসে রে…

 

                    পেটটি ভরান দুব্বোঘাসে-

                   বস্তা ভরে টিফিন আসে…

          বাছুরবাবু মনের দুঃখে কেঁদে ফেলেন রে…

 

                   ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বটের ছায়া

                   পেটটি পুরে ঘাসটি খাওয়া-

         এমন সুখটি বাঘুবাবু কোথায় পাবেন রে…

 

                    বাঘের ঘরে ঘোগটি এলো

                    ঘাসটি খাওয়া লাটে উঠলো-

          চোখটি ভরে বাঘুবাবুর জল আসে রে…

 

                    গোরুমশাই রাগী ভারি,

                    ফাঁস যে হোল জারিজুরি-

       লম্বাগুড়ি দেবেন বাঘু, দিয়েই যাবেন রে…।।

 

 

………০………

‘বাঘু’ সিরিজের অন্যান্য গল্পগুলি পড়তে ক্লিক করুনঃ-

বাগে এল বাঘু

গিঁটের গেরোয় বাঘু

 

 

Leave a comment

Check Also

আশমানি পাঠশালা

আশমানি পাঠশালা – ইন্দ্রানী ভট্টাচার্য্য

  ” ডান দিকটা একটু ওপরে উঠে গেছে। নামা। ব্যস, ঠিক আছে। এবার দড়িটা শক্ত …

বিদেশি মোলাকাতে বাঘু- মৌসুমী পাত্র

            ধুস! ধুস! ধুস! ‘দূর ছাতা’ বলে যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে …

baghu_kobi sommelan

কবি সম্মেলনে বাঘুবাবু – মৌসুমী পাত্র

            পাঠশালায় আসছিল শিয়ালনি। আজ দেরিই হয়েছে কিছুটা। কাল সন্ধেবেলা খরগোশাই ডাক্তারদিদির বাড়ি নিমন্ত্রণ …

উল্কার কবলে বাঘু

উল্কার কবলে বাঘু – মৌসুমী পাত্র

(শিয়ালনীর পাঠশালায় প্রচুর মজাদার ব্যাপার স্যাপার চলে, যার প্রথম হদিশটা  তোমাদের দিযছিলাম ‘বাগে এলো বাঘু’ …